রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৬

আগের পর্বগুলো পড়ুন:

রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ১ ক্লিক করুন

রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ২ ক্লিক করুন

রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৩ ক্লিক করুন

রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৪ ক্লিক করুন

রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৫ ক্লিক করুন

মহেন্দ্রনাথ রায়  (           - ১৯৩০)

 মহেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম শহীদ বিপ্লবী বিপ্লবী দলে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিলো মেছুয়াবাজার বোমার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বিচারে কয়েক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়, কিন্তু আপিলে ছাড়া পান ১৯৩০ সালে আবার ধরা পড়েন এবং রাজস্থানের দেউলি বন্দী-শিবিরে পাঠানো হয় এখানে নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে মারা যান

 মেছুয়াবাজার বোমার মামলার ঘটনা ঘটে ১৯১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এই মামলায় নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, সতীশচন্দ্র পাকড়াশী, রমেশচন্দ্র বিশ্বাস, সুধাংশু দাসগুপ্ত, নিশাকান্ত রায়চৌধুরী, সুধীর কুমার আইল, দেবপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়, শচীন্দ্রলাল করগুপ্ত, মুকুল রঞ্জন সেন, সুধাংশু মজুমদার, বিহারীলাল বিশ্বাস, মহেন্দ্রনাথ রায়, তারাপদ গুপ্ত, সত্যব্রত সেন, রবীন্দ্রনাথ বসু সুবোধ চক্রবর্তী সাত বৎসর পাঁচ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন মুকুল সেন, শচীন্দ্রলাল করগুপ্ত, জগদীশ চট্টোপাধ্যায়, নির্মল দাস মুক্তি পান এবং এঁরা সকলেই তরুণ বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন

মহেশ চন্দ্র রায় (১৯১৮- ১৯৯৩)

 মহেশ চন্দ্র রায়  উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী কানিছাত গারুনু আকাশি আকালী, টুলটুলিরে টুলটুলি দিনাও বেড়াইস চুলখুলি, কোঁড়ক কোঁড়ত কড়কা বাজে, তুই যাগে নানী থুইয়া আয় এলায়, দয়াল তুই আরিনে মোর নিদানে, বিয়াও বিয়াও করিস না ম্, আবো তুই মরিয়া গেইলে নাইওর মোক কায় নিগাইবে, না দেখো তোর টেরিয়া সিতা’, ‘ওরে ফোঁক দিও না প্রাণবন্ধুয়া মাকলা বাঁশের বাঁশিতে ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি 

 মহেশচন্দ্র রায়ের জন্ম ১৩২৫ সালের ১৯ মাঘ (১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি) দলিত শ্রেণীভুক্ত রাজবংশী ক্ষত্রিয় বংশে তার গ্রাম পুটিমারী (তৎকালীন রংপুর), বর্তমানে নীলফামারী জেলার কিশোরীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত বাবা বাবুরাম রায় মাতা বিমলা রানী জন্মের পাঁচ বছর পরেই মহেশ রায়ের মা মারা যান পিতার আদরে লালিত-পালিত শিশু মহেশকে বাবা গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি করান তিন বছরের মাথায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে কিশোরীগঞ্জ ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন ১১-১২ বছর বয়সেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে

 শিক্ষাজীবন শেষ করে যোগ দেন গ্রাম্য যাত্রা সংকীর্তন প্রভৃতির দলে জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠেন অল্প দিনেই সময় বাবা ছেলের ভবিষ্যত উন্নতির জন্য নীলফামারীর প্রবীণ উকিল সুরথ কুমার ঘোষের তত্ত্বাবধানে রেখে আসেন শহরে এই শহরে ঘটনাক্রমে পরিচয় ঘটে ভারতবর্ষ অবতার পত্রিকার লেখক অধ্যাপক তারা প্রসন্ন মুখোপাধ্যায় লেখক বলাই দেব শর্ম্মার সঙ্গে তাদের নির্দেশেই পরবর্তীকালে তিনি সংগ্রহ করতে শুরু করেন প্রাচীন পুঁথি কণ্ঠে ধারণ করতে থাকেন এই গানের অনেকগুলোই

রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৬

 নীলফামারী শহরে তার পালনকর্তা সুরথ কুমার ঘোষের মৃত্যুর পর মহেশচন্দ্র ছেড়ে দেন শহরবাস এর মধ্যেই গান গাওয়ার সুবাদে তিনি শিক্ষকতার সুযোগ পান শহর থেকে দূরে জয়চণ্ডী পুটীহারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৩৪৪ থেকে ১৩৪৬ সন পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন তিনি বিদ্যালয়ে আর সে সময়ই সংগলসী ইউনিয়নের দীঘলডাঙ্গী গ্রামের গগনচন্দ্র রায়ের কন্যা বীণাপাণি রায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং স্থায়ীভাবে থেকে যান শ্বশুরালয়েই কিন্তু বেশিদিন টেকেনি তার স্থায়ী দাম্পত্য জীবন স্ত্রী বীণাপাণি মৃত্যুবরণ করেন ১৩৪৯ সনে দুটি সন্তান রেখে ১৩৫০ সনে তিনি বিয়ে করেন কামিনী বালা রায়কে কয়েক বছর পর চারটি সন্তান রেখে দ্বিতীয় স্ত্রীরও বিয়োগ ঘটে দীর্ঘদিন ধরে মাতৃহীন সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করার পর শেষ বয়সে সরলা বালা নামক একজন বিধবাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছিলেনপাকিস্তান আমলে তিনি রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে কণ্ঠস্বর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গীতিকার, সুরকার সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিমাসে অনিয়মিত শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন সেখানে কয়েক বছর অতিবাহিত করার পর রংপুর কেন্দ্রে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন

 মহেশচন্দ্র রায় তার দীর্ঘ জীবনে যে গানগুলো সৃষ্টি করেছেন, ধারণ করেছেন, সেগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের চেষ্টাও চালিয়েছেন নিরন্তর তার লেখা সুর করা গানগুলো গেয়েছেন বাংলাদেশের ভাওয়াইয়া গানের প্রধান শিল্পী মুস্তফা জামান আব্বাসী, শরিফা রানী, নাদিরা বেগম, রথীন্দ্রনাথ রায়সহ আরও অনেকে বাংলা একাডেমী শিল্পকলা একাডেমী প্রকাশ করেছে গানের সঙ্কলন জীবনী এবং ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস বাংলাদেশ বেতার আর্কাইভসে সংরক্ষিত হচ্ছে তার গানের সুর কথিত আছে যে, মহেশচন্দ্র রায়ের লিখিত গানের সংখ্যা এক হাজারের মতো কিন্তু গবেষকের তথ্য অনুযায়ী সংগ্রহ করা গেছে মাত্র ২০০ গান ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মহেশ চন্দ্র রায় রচিতধীরে বোলাও গাড়ী’ (প্রথমখন্ড) নামে একটি গানের বই নীলফামারী শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে প্রকাশ করা হয় ২০০৩ সালে বাংলা একাডেমী থেকেমহেশ চন্দ্র রায়ের গাননামে একটি বই বের করা হয় ২০১০ সালে শিল্পকলা একাডেমীভাওয়াইয়া শিল্পী মহেশ চন্দ্র রায়ের জীবনী গাননামে একটি বই প্রকাশ করে এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীঁত বিষয়ে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় শিল্পীর গান জীবনী  এই শিল্পী ১৯৯৩ সালের ২৯ জানুয়ারি ৭৫ বছর বয়সে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন

সত্যজিৎ রায় ( মে ১৯২১২৩ এপ্রিল ১৯৯২)

 আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ১৮ বৈশাখ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এঁর পিতামহ ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (লেখক, চিত্রকর, ভারতীয় মুদ্রণশিল্পের পথিকৃত) পিতার নাম সুকুমার রায় (প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক), মায়ের নাম সুপ্রভা দেবী এঁদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার মসুয়া গ্রামেপ্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তাঁর মায়ের কাছে বৎসর বয়সে (১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ) বালিগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে তিনি ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ প্রেসিডেন্সি কলেজে এই কলেজে প্রথম দুবছর বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন শেষ বছরে বিষয় পাল্টে তিনি অর্থনীতি পড়েন ফলে তাঁর লেখাপড়ার সময় দীর্ঘতর হয়ে উঠে এই সময়ে ইনি পাশ্চাত্য চিরায়ত চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীত নিয়ে এতটাই আগ্রহী হয়ে উঠেন যে, তাঁর মূল পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে শেষ পর্যন্ত তিনি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিএ (অনার্স) পাশ করেন

 মায়ের উৎসাহে সত্যজিৎ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে যান এবং সেখানকার কলাভবনে ভর্তি হন এই সূত্রে তিনি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছে শিক্ষালাভের সুযোগ পান নিয়মানুযায়ী বিশ্বভারতীতে সত্যজিতের পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও তার আগেই তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ডি জে কেমার নামক ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থায় 'জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার' পদে যোগদান করেন এখানে তিনি বেতন পেতেন  ৮০ টাকা ইনি প্রথম বিজ্ঞাপনে ভারতীয় ধাঁচের ক্যালিওগ্রাফিক উপাদান ব্যবহার করা শুরু করেন একই সঙ্গে তিনি অক্ষরশৈলীতে বিশেষ আগ্রাহী হয়ে উঠেন তাঁর নকশা করা দুটি ফন্ট 'Ray Roman' এবং 'Ray Bizarre' ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করেছিল

 এই সময় থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে চলচ্চিত্র দেখা শুরু করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের সাথে যোগাযোগ করে নতুন মার্কিন চলচ্চিত্রগুলোর বিষয়ে খবর নিতেন বিশেষ করে নরম্যান ক্লেয়ার নামের রয়্যাল এয়ারফোর্সের এক কর্মচারী বিষয়ে তাঁকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহগুলোতে হলিউডে নির্মিত প্রচুর ছবি দেখানো হতো এই সূত্রে হলিউডের চলচ্চিত্রগুলো কলকাতার চলচ্চিত্র প্রেমিকদের কাছে প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ এবং বংশী চন্দ্রগুপ্ত কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন এই সোসাইটিতে চলচ্চিত্র দেখানো হতো এবং এই বিষয়ে পরে ঘরোয়াভাবে আলোচনার ব্যবস্থা করা হতো উল্লেখ্য এই সমিতি প্রথম প্রদর্শন করেছিলব্যাটেলশিপ পটেমকিন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি নির্বাক চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার সেরগেই আইজেনস্টাইন

 সত্যজিৎ সাধারণ মানুষের কাছে ততটা পরিচিত হয়ে না উঠলেও, কলকাতার চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর নামটি বেশ সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল এই কারণেই ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে যখন ফরাসি চলচ্চিত্রকার জঁ রেনোর তাঁর দ্য রিভার ছবি নির্মাণের জন্য কলকাতায় আসেন, তখন সত্যজিৎকে তাঁর ছবির চিত্রগ্রহণের উপযোগী স্থান খোঁজার ক্ষেত্রে সাহায্যকারী হিসাবে খুঁজে নিয়েছিলেন এটাই ছিল আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত কোনও প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় এই সময়ই তিনি রেনোর' কাছে পথের পাঁচালী- চলচ্চিত্রায়ণ নিয়ে আলাপ করেন রেনোর এই বিষয়ে বিশেষ ভাবে তাঁকে উৎসাহিত করেন এবং অনেকে মনে করেন, বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের মৌলিক উপাদনগুলো সম্পর্কে রেনরো- কাছ থেকে তিনি বিশেষ ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন

 ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সত্যজিৎ তাঁর দূরসম্পর্কের বোন বহু দিনের বান্ধবী বিজয়া দাসকে বিয়ে করেন রেনোর তাঁর ছবিতে সত্যজিতের বন্ধু বংশী চন্দ্রগুপ্তকে শিল্প নির্দেশক এবং সহযোগী হিসাবে নেন হরিসাধন দাসগুপ্তকে এই ছবিতে সুব্রত মিত্রও ছিলেন পরে ইনি সত্যজিৎ-এর ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসাবে কাজ করেছেন এই ছবিতে কাজ করার জন্য সত্যজিতের ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তিনি তখনও বিজ্ঞাপন সংস্থায় শিল্প নির্দেশক হিসাবে কর্মরত ছিলেন এই সংস্থা সত্যজিৎকে তাদের লন্ডনস্থ প্রধান অফিসে কাজ করার জন্য পাঠান

 লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি প্রায় 'খানেক চলচ্চিত্র দেখেন এর ভিতরে ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে (ইতালীয় Ladri di biciclette ইংরেজি Bicycle Thieves (সাইকেল চোর) দেখেন এই ছবিটি তাঁকে পথের পাঁচালী তৈরিতে বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করেছিলএই ছবি তৈরির জন্য পথের পাঁচালীর লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধবা স্ত্রী রমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অনুমতি নেন তিনি তাঁর জমানো টাকা, বিমা কোম্পানি থেকে গৃহীত ঋণ এবং কতিপয় বন্ধু আত্মীয় স্বজনের সহায়তায় ১৯৫২ সালের শেষ দিকে দৃশ্যগ্রহণ শুরু করেন আর্থিক অসুবিধার কারণে, থেমে থেমে এই ছবি তৈরি করতে তাঁর প্রায় দীর্ঘ তিন বছর লেগে গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৫৫ সালে ছবিটি নির্মাণ সম্পন্ন হয় সেই বছরের ২৬ আগস্ট তারিখে ছবিটি মুক্তি পায় মুক্তি পাওয়ার পর পরই ছবিটি দর্শক-সমালোচক সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করে ছবিটি বহু দিন ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এবং ভারতের বাইরে প্রদর্শিত হয়

 এই ছবির সাফল্যের পর তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তিনি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করেন অপরাজিত এই ছবি তাঁকে আন্তর্জাতিক মহলে উচ্চাসনে পৌঁছে দেয় এই ছবির জন্য তিনি ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার লাভ করেন 'অপু-ত্রয়ী' শেষ করার আগে সত্যজিৎ আরও দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ সমাপ্ত করেন প্রথমটি ছিল ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত পরশপাথর, আর পরেরটি ছিল জলসাঘর (১৯৫৮) এর পর 'অপু-ত্রয়ী'-এর শেষ অপুর সংসার তৈরি করেন ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে

 আন্তর্জাতিক ভাবে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবেই সর্বাধিক পরিচিত কারণ, তাঁর সৃষ্ট ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক ভাবে প্রচারিত হয়েছে সব চেয়ে বেশি তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছিল, এদের মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া "শ্রেষ্ঠ মানব দলিল" (Best Human Document) পুরস্কারটি পথের পাঁচালি, অপরাজিত অপুর সংসারএই তিনটি চলচ্চিত্রকে একত্রে 'অপু-ত্রয়ী' বলা হয় এটি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বা ম্যাগনাম ওপাস হিসাবে বহুল স্বীকৃত১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ঘরে বাইরে ছবির কাজ করার সময় সত্যজিতের হার্ট অ্যাটাক হয় এবং ঘটনার পর অবশিষ্ট নয় বছরে তাঁর কাজের পরিমাণ ছিল অত্যন্ত সীমিত স্বাস্থ্যগত কারণে ঘরে বাইরে নির্মাণের সময় তাঁর ছেলে সন্দীপ রায়ের সহায়তা নিয়েছিলেন উল্লেখ্য ১৯৮৪ সালে ছবিটি সমাপ্ত করেছিলেন ১৯৮৭ সালে সত্যজিৎ তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন শারীরিক অসুস্থতার পরেও সত্যজিৎ তিনটি ছবি করেছিলেন এই ছবি তিনটি হলো - গণশত্রু (১৮৮৯), শাখা প্রশাখা (১৯৯০), আগন্তুক (১৯৯০)১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল হৃদরোগ প্রকট আকার ধারণ করলে সত্যজিৎ হাসপাতালে ভর্তি হন মৃত্যুর কিছু সপ্তাহ আগে অত্যন্ত অসুস্থ শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি তাঁর জীবনের শেষ পুরস্কার সম্মানসূচক অস্কার গ্রহণ করেন ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ মৃত্যুবরণ করেন

 সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবদ্দশায় প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন তিনিই দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাঁকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে প্রথম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে অক্সফোর্ডের ডিলিট পেয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার তাঁকে সে দেশের বিশেষ সম্মনসূচক পুরস্কার লেজিওঁ নরে ভূষিত করে ১৯৮৫ সালে পান ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বে অ্যাকাডেমি তাকে আজীবন সম্মাননাস্বরূপ অ্যাকাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার প্রদান করে মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বেই ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করেন দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন সেই বছরেই মৃত্যুর পরে তাঁকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয় প্রয়াত পরিচালকের পক্ষে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন শর্মিলা ঠাকুর

 সত্যজিতের পরিচালিত চলচ্চিত্র

 অপু-ত্রয়ী

পথের পাঁচালী (১৯৫৫), অপরাজিত (১৯৫৬) অপুর সংসার (১৯৫৯)

 কলকাতা-ত্রয়ী

 প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০), সীমাবদ্ধ (১৯৭১) জন অরণ্য (১৯৭৬)

 গুপি-বাঘা সিরিজ

 গুপি গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৯), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০)

 ফেলুদা সিরিজ

সোনার কেল্লা (১৯৭৪), জয়বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮)

 অন্যান্য চলচ্চিত্র 

 পরশপাথর (১৯৫৮), জলসাঘর (১৯৫৮), দেবী (১৯৬০), তিন কন্যা (১৯৬১), কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২), অভিযান (১৯৬২), মহানগর (১৯৬৩), চারুলতা (১৯৬৪), কাপুরুষ মহাপুরুষ (১৯৬৫), নায়ক (১৯৬৬), চিড়িয়াখানা (১৯৬৭), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), অশনি সঙ্কেত (১৯৭৩), শতরঞ্জ কি খিলাড়ি (১৯৭৭), সদগতি (১৯৮১), ঘরে বাইরে (১৯৮৪), গণশত্রু (১৯৮৯), শাখাপ্রশাখা (১৯৯০) এবং আগন্তুক (১৯৯১)


হরলাল রায় (১৯৩২-১৯৯৪)

হরলাল রায় একজন কণ্ঠশিল্পী গীতিকার তিনি ১৯৩২ সালে এপ্রিল নীলফামারী জেলার, সুবর্ণখালী (ব্রিটিশ ভারত-বর্তমানে বাংলাদেশ) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি টিভি বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন ছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ভাওয়াইয়া সঙ্গীতে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্যতিনি জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় -এর পিতা

 জাতীয়তা : বাংলাদেশী

 পেশা : চলচ্চিত্র অভিনেতা

 পরিচিতির কারণ : ভাওয়াইয়া সংগীত অভিনয়

 তিনি নভেম্বর, ১৯৯৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন

রথীন্দ্রনাথ রায় (১৯৪৯-        )

 রথীন্দ্রনাথ রায় বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের একজন প্রখ্যাত শিল্পী তিনি মূলত বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে প্রচলিত লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া গানের একজন শিল্পী তিনি অনেক দেশাত্মবোধক গান গেয়ে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন তিনি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারের নিয়মিত কণ্ঠশিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন করে অনন্য ভূমিকা পালন করেন এবং কণ্ঠযুদ্ধশিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন

 রথীন্দ্রনাথ রায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জানুয়ারি, নীলফামারী জেলার, সুবর্ণখালী (ব্রিটিশ ভারত-বর্তমানে বাংলাদেশ) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তার পিতা অন্যতম লোকসঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার সুরকার হরলাল রায় তিনি ছোটবেলা থেকে সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন এবং বাবার কাছেই সঙ্গীতের প্রাথমিক তালিম গ্রহণ করেন এরপর তিনি ওস্তাদ পি. সি গমেজের কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন আট বছর বয়সে তিনি বেতারে তের বছর বয়সে টেলিভিশনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন রথীন্দ্রনাথ রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন তিনি দুবার ১৯৭৯ ১৯৮১ সালে ফিল্ম জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন পুরস্কারে ভূষিত হন এবং ১৯৯৫ সালে একুশে পদক লাভ করেন বর্তমানে তিনি কানাডা প্রবাসী৷

জাতীয়তা : বাংলাদেশী

পরিচিতির কারণ : ভাওয়াইয়া সংগীতের জন্য

বাচসাস পুরস্কার (১৯৭৯, ১৯৮১)

আর্টিকেল'টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিবেন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।
গৌরব রায়
বাংলা বিভাগ, 
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ। 
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে : ক্লিক করুন
তথ্যসূত্র:
আর্টিকেলের সকল তথ্য উইকিপিডিয়া ও গুগল থেকে নেওয়া!

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.