শ্রীমঙ্গল উপজেলার তথ্যাদি: পার্ট-৩; শ্রীমঙ্গল উপজেলার চা প্রসঙ্গ বলো? শ্রীমঙ্গল উপজেলার আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্পর্কে বলো? শ্রীমঙ্গল উপজেলার শিক্ষা প্রসঙ্গে বলো?

৯. শ্রীমঙ্গল উপজেলার চা প্রসঙ্গ বলো? 

বাংলাদেশের বর্তমান ভৌগোলিক সীমানায় চায়ের বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু হয় আজ থেকে ১৬০ বছর আগে । ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের মালনিছড়ায় বাংলাদেশের প্রথম চা - বাগান প্রতিষ্ঠিত হয় । তারপর শ্রীমঙ্গলের বিস্তির্ণ এলাকাজুড়ে চা বাগান প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে ধীরে ধীরে বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকায় বিস্তৃত হয় চায়ের ভূবন

একশত বছরেরও পুরনো এই চা শিল্পকে বৈজ্ঞানিকভাবে সমর্থন দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান চা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ( পিটিআরএস ) স্থাপন করে । তবে তা খুব একটা কার্যকরী হয়নি । প্রতিষ্ঠার সময়কালে শীর্ণকায় এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অফিসার ও সাধারণ কর্মচারীদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত সীমিত শ্রীমঙ্গলের প্রায় অর্ধেক অঞ্চল জুড়ে রয়েছে চা বাগান । এই সকল চা বাগানে শ্রীমঙ্গলের জনসংখ্যার বিরাট একটা অংশ কাজ করছে । 

তবে চা বাগানের কর্মচারীদের বেশিরভাগই অবাঙালি । ব্রিটিশ আমলে চা উৎপাদনের জন্য তাদেরকে মধ্য ভারত থেকে বাংলার ভূখণ্ডে আনা হয়েছিল । বাংলাদেশের চা বাগানে ৩,০০,০০০ অধিক বাগানি কর্মরত আছে । যার ৭৫ % নারী । অনেক শ্রমিকই উপজাতি বাসিন্দা যাদের ব্রিটিশ শাসনামলে মধ্য ভারত থেকে নিয়ে আসা হযেছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা পূর্বকালে ৪২,৬৮৮ হেক্টর জমি চা আবাদী এলাকার আওতায় চলে আসে । ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার স্বাধীন হওয়ার প্রায় দেড় বছরের মধ্যে রাষ্ট্রের চা শিল্পকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর উত্তরোত্তর উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ইনাষ্টটিউটএ রূপান্তর করে । এর নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট ( বিটিআরআই ) । বিটিআরআই এর মাধ্যমে অধিক ফলন ও মানসম্মত চা পাওয়ার লক্ষ্যে ছাঁটাই , চয়ন , রোপন দূরত্ব ইত্যাদির উন্নতকরণ সম্ভব হয়েছে । 

এছাড়া চা প্রক্রিয়াজাত করণ পদ্ধতির আধুনিকায়ন , চায়ের বিকল্প ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে এখানে পবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে । শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত এই বাংলাদেশ চা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে প্রস্তুত চায়ে বালাইনাশক বা অন্য কোন ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি নিরূপণের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে রেসিডিউ এনালাইটিক্যাল গবেষণাগার স্থাপন করা হয়েছে । প্রায় দেড় শ বছরের পুরনো বাংলাদেশের এই প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ চা শিল্পের ইতিহাস , ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যাতে নতুন প্রজন্ম ধরে রাখতে পারে সে লক্ষ্যে টি মিউজিয়াম বা চা জাদুঘর স্থাপন করেছে চা বোর্ড । ১৬ সেপ্টেম্বর , ২০০৯ এ বাংলাদেশ চা বোর্ড এই চা জাদুঘর উদ্বোধন করা হয় ব্রিটিশ আমলে চা - বাগানগুলোতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের সঙ্গে এ শিল্পের ঐতিহ্যের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য দেশের চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গলে স্থাপিত হয়েছে চা জাদুঘর । জাদুঘরের জন্য এ পর্যন্ত ব্রিটিশ আমলে চা - বাগানে ব্যবহৃত প্রায় শতাধিক আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়েছে । এর মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতার আগে চা বোর্ডের দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহৃত চেয়ার - টেবিলও । এখনে থাকবে চায়ের উপকারিতা , চায়ের আবিষ্কার কাহিনীসহ চায়ের এ পর্যন্ত বাংলাদেশে উদ্ভাবিত সকল প্রকার বিটি ক্লোনের উপস্থিতি । শ্রীমঙ্গল উপজেলার টি রিসোর্টের তিনটি কক্ষে চা জাদুঘর করা হয়েছে । 

১৯৫৭-৫৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন । আর সেই সুবাদে তিনি এসেছিলেন শ্রীমঙ্গলের নন্দবানী চা বাগানে । তৎকালিন সময়ে বঙ্গবন্ধু যে চেয়ারে বসে মিটিং করেছিলেন সেই চেয়ার ও টেবিল , পাথর হয়ে যাওয়া আওয়াল গাছের খণ্ড , ব্রিটিশ আমলের ফিলটার , ফসিল , কম্পাস , চা গাছের মোড়া ও টেবিল , তীর - ধনুকসহ নাম না - জানা আরও কিছু সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়েছে এবং এখনো সংগ্রহের কাজ বন্ধ হয়নি । এই অঞ্চলের গৌরবান্বিত চা শিল্পের ইতিহাস ধরে রাখার জন্যই এত সকল পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কারণ ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে চা উৎপাদন করার পরিকল্পনা রয়েছে । বর্তমানে শ্রীমঙ্গলে রয়েছে ৪০ টি চা - বাগান । যা ৪৫,৫৩৮ একর ( ১৮৪.২৯ বর্গ কিলােমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থান করছে । 

১০. শ্রীমঙ্গল উপজেলার আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্পর্কে বলো? 

শ্রীমঙ্গল বাংলাদেশের সবথেকে শীতল ও বৃষ্টিপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত । এরপরও এ অঞ্চল শীতকাল ছাড়া সারা বছরই নাতিশীতোষ্ণ থাকে । শ্রীমঙ্গলে শীত মৌসুম ( নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ) খুবই শুষ্ক থাকে । এসময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাৎসরিক সর্বমোট বৃষ্টিপাতের ৪ শতাংশেরও নিচে থাকে । ভারতের উত্তর - পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা পশ্চিমা বায়ু শীত মৌসুমে বাংলাদেশের এই অঞ্চলে ৪০ মিমি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে থাকে । নভেম্বরের শুরুর দিকে শীতের এ আগমনের সঙ্গে অঞ্চলজুড়ে আসতে থাকে হাজার - হাজার পরিযায়ী পাখি । এখানকার বাইক্কা বিলের মৎস্য অভয়ারণ্যে সুদূর সাইবেরিয়া , মধ্য এশিয়া , ইউরোপ অঞ্চলসহ বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে অতিথি পাখিরা আসতে শুরু করে । এদের মধ্যে রযেছে ল্যাজা হাঁস , বেগুনি কালেম , পাতি সরালি ইত্যাদি

বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত আরহাওয়ার রেকর্ড রয়েছে । তারমধ্যে ২০১৮ সালে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার আগে ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস । যা দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল । যদিও বাংলাদেশে বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সংঘটিত হয় বর্ষা মৌসুমে ( জুন থেকে অক্টোবর ) । তবে শ্রীমঙ্গলে মার্চ এর মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অর্থাৎ শীতকাল বাদে সারাবছরই বৃষ্টিপাত হয় । তবে জুন থেকে অক্টোবর মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি থাকে এ মৌসুমে অধিক বৃষ্টিপাতের মূল কারণ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট দুর্বল নিম্নচাপসমূহ এবং সমুদ্র থেকে বাংলাদেশের ভূখন্ড অভিমুখী আর্দ্র মৌসুমি বাযু । বর্ষা মৌসুমেও বাংলাদেশের উত্তর - পূর্বাঞ্চলে ( শ্রীমঙ্গল এই অবস্থানে ) অধিক মাত্রায় বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে মেঘালয় পর্বতের প্রভাব রয়েছে সাধারণত মধ্য অক্টোবরের পর আর্দ্র মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ স্তিমিত হয়ে গেলে দ্রুত বৃষ্টিপাত হ্রাস পেতে থাকে । ২০১৭ এর এপ্রিল মাসে যখন বাংলাদেশে ১১৯.৭ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছিল তখন শ্রীমঙ্গলে অস্বাভাবিক ১৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করা হয় । যা এর আগের ৩৪ বছরে দেখা যায়নি । 

১১. শ্রীমঙ্গল উপজেলার শিক্ষা প্রসঙ্গে বলো? 

দি বাডস রেসিডেন্সিয়্যাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ইংলিশ মিডিয়াম অংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনেক আগেই এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয় । ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীমঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত হয় ডোবারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় । ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দশরথ বহুপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় । তারপর ১৯২৪ সালে ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় । 

কিন্তু কয়েক দশক যাবৎ শ্রীমঙ্গলের শিক্ষার হার বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক কম ছিলো । এর প্রধান কারণ শ্রীমঙ্গলের ভু - খন্ডের অর্ধেকই চা বাগান অধ্যুষিত অন্যদিকে হাওর পাড়ে বিশাল এক জনগোষ্ঠী বরাবরই ছিল অবহেলিত । তাদের প্রধান অন্তরায় ছিল বিদ্যালয় সংকট , অনুন্নত রাস্তাঘাট । বংশ পরম্পরায় তারা ছিল শিক্ষাবঞ্চিত । এগুলোই মূলত চা বাগান ও চা বাগান বহির্ভূত অঞ্চলের শিক্ষার হারের তারতম্যের কারণ । 

২০০১ সালে চা বাগান ও হাওর অঞ্চলের নগনসহ শ্রীমঙ্গলের শিক্ষার হার ছিলো ৩৯.৬ % ; পুরুষ ৪৪.৩ % , মহিলা ৩৪.৬ % । 

শ্রীমঙ্গলে কলেজ সংখ্যা ৪ টি , মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২০ টি , কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১ টি ও মাদ্রাসা ৭ টি ছিলো

স্বল্পোন্নত দেশের স্ট্যাটাস হতে উন্নয়নশীল দেশে উওরণের যোগ্যতা অর্জনের ঐতিহাসিক সাফল্য উদযাপনের লক্ষ্যে শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের ছাত্র , শিক্ষক , অভিভাবকের আনন্দ শোভাযাত্রা করেন । ২০১০ সালেও শ্রীমঙ্গলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালযের সংখ্যা ছিল ৬৬ টি । আর ২০১৩ সালে এর সংখ্যা দাড়িয়েছে ১৩৮ টি । ২০১০ সালে শ্রীমঙ্গলে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ১৩ জন , যা প্রতিবছরই বৃদ্ধি পেতো । ঐ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় গামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের নিচে আর ২০১৩ সাল নাগাদ বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৫ হাজারের উপরে । আর ২০১০ সালের দিকে সরকারি শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ শত থেকে দিগুণেরও বেশি বেড়ে ২০১৬ সালে সরকারি শিক্ষকের সংখ্যা ৭০৪ জন । এরপর ২০১৬ সালে শ্রীমঙ্গলে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৯৯.২৯ % । বর্তমানে ( ২০১৮ খ্রি . ) শ্রীমঙ্গলে স্কুলগামী ছাত্রের সংখ্যা প্রায় শতভাগ । বর্তমানে পাশের হার ও এ প্লাস পাওয়ার দিক থেকে শ্রীমঙ্গলের স্কুল কলেজগুলোতে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে । 

শ্রীমঙ্গলের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ , দি বাডস্ রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ , দ্বারিকাপাল মহিলা ডিগ্রি কলেজ , ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ( ১৯২৪ ) , চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ( ১৯২৪ ) , শ্রীমঙ্গল আনওয়ারুল উলুম ফালি ( ডিগ্রি )মাদ্রাসা , বিটিআরআই হাইস্কুল এন্ড কলেজ , দশরথ বহুপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ( ১৮৯৬ ) , আছিদ উল্লা উচ্চ বিদ্যালয় ভুজপুর ( ১৯৩৬ ) সামাদিয়া আলিয়া মাদ্রাসা সাতগাঁও ( ১৯৬৩ ) । ডোবারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ( ১৮৮২ ) , শ্রীমঙ্গল কাদিরিয়া লতিফিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা , উত্তরসুর কুলচন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় । 

আর্টিকেল'টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিবেন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।
গৌরব রায়
বাংলা বিভাগ, 
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ। 
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে : ক্লিক করুন

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.