রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৪

আগের পর্বগুলো পড়ুন:

রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ১ ক্লিক করুন

রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ২ ক্লিক করুন

রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৩ ক্লিক করুন


কামিনী রায় (জন্মঃ অক্টোবর ১২, ১৮৬৪ - মৃত্যুঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ১৯৩৩)

কামিনী রায় একজন প্রথিতযশা বাঙালি কবি, সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকাতিনি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ডিগ্রীধারী ব্যক্তিত্বতিনি একসময় "জনৈক বঙ্গমহিলা" ছদ্মনামে লিখতেন

কামিনী রায়ের জন্ম পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) বাকেরগঞ্জের বাসণ্ডা গ্রামে (বর্তমানে যা বরিশাল জেলার অংশ)। তার পিতা চণ্ডীচরণ সেন একজন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী, বিচারক ঐতিহাসিক লেখক ছিলেন১৮৭০ খ্রীস্টাব্দে চণ্ডীচরণ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা লাভ করেনপরের বছর তার স্ত্রী-কন্যাও কলকাতায় তার কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হনতিনি ব্রাহ্ম সমাজের বিশিষ্ট নেতা ছিলেনতার ভগিনী যামিনী সেন লেডি ডাক্তার হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন১৮৯৪ খ্রীস্টাব্দে কামিনীর সাথে স্টাটুটারি সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায়ের বিয়ে হয়

কন্যা কামিনী রায়ের প্রাথমিক শিক্ষার ভার চণ্ডীচরণ সেন নিজে গ্রহণ করেনবার বৎসর বয়সে তাকে স্কুলে ভর্তি করে বোর্ডিংয়ে প্রেরণ করেন১৮৮০ খ্রীস্টাব্দে তিনি কলকাতা বেথুন স্কুল হতে এন্ট্রান্স (মাধ্যমিক) পরীক্ষা ১৮৮৩ খ্রীস্টাব্দে এফ. বা ফার্স্ট আর্টস (উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হনবেথুন কলেজ হতে তিনি ১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দে ভারতের প্রথম নারী হিসাবে সংস্কৃত ভাষায় সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। 

স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর ১৮৮৬ সালেই তিনি বেথুন কলেজের স্কুল বিভাগে শিক্ষীকার পদে নিযুক্ত হনপরবর্তীকালে তিনি কলেজে অধ্যাপনাও করেছিলেনযে যুগে মেয়েদের শিক্ষাও বিরল ঘটনা ছিল, সেই সময়ে কামিনী রায় নারীবাদে বিশ্বাসী ছিলেনতার অনেক প্রবন্ধেও এর প্রতিফলন ঘটেছেতিনি নারী শ্রম তদন্ত কমিশন (১৯২২-২৩) এর সদস্য ছিলেন

শৈশবে তার পিতামহ তাকে কবিতা স্তোত্র আবৃত্তি করতে শেখাতেনএভাবেই খুব কম বয়স থেকেই কামিনী রায় সাহিত্য রচনা করেন কবিত্ব-শক্তির স্ফূরণ ঘটানতার জননীও তাকে গোপনে বর্ণমালা শিক্ষা দিতেনকারণ তখনকার যুগে হিন্দু পুরমহিলাগণের লেখাপড়া শিক্ষা করাকে একান্তই নিন্দনীয় গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হতোমাত্র বছর বয়স থেকে তিনি কবিতা লিখতেনরচিত কবিতাগুলোতে জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনার সহজ-সরল সাবলীল প্রকাশ ঘটেছেপনেরো বছর বয়সে তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ আলো ছায়া প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ খ্রীস্টাব্দে গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কিন্তু প্রথমে এতে গ্রন্থকর্ত্রী হিসেবে কামিনী রায়ের নাম প্রকাশিত হয় নাইগ্রন্থটি প্রকাশিত হলে তার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েতার লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে -

  • আলো ছায়া (১৮৮৯)

  • নির্মাল্য (১৮৯১)

  • পৌরাণিকী (১৮৯৭)

  • মাল্য নির্মাল্য (১৯১৩)

  • অশোক সঙ্গীত (সনেট সংগ্রহ, ১৯১৪)

  • অম্বা (নাট্যকাব্য, ১৯১৫)

  • দীপ ধূপ (১৯২৯)

  • জীবন পথে (১৯৩০)

  • দ্রোণ-ধৃষ্টদ্যুম্ন

  • শ্রাদ্ধিকী

অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত মহাশ্বেতা পুণ্ডরীক তার দুটি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতাএছাড়াও, ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য গুঞ্জন নামের কবিতা সংগ্রহ প্রবন্ধ গ্রন্থ বালিকা শিক্ষার আদর্শ রচনা করেন

কামিনী রায় সবসময় অন্য সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিতেন১৯২৩ খ্রীস্টাব্দে তিনি বরিশাল সফরের সময় কবি সুফিয়া কামালকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করতে বলেন

তার কবিতা পড়ে বিমোহিত হন সিবিলিয়ান কেদারনাথ রায় এবং তাকে বিয়ে করেন১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে কামিনী রায়ের স্বামীর অপঘাতে মৃত্যু ঘটেছিলসেই শোক দুঃখ তার ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে, যা তার কবিতায় প্রকাশ পায়তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংস্কৃত সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন

  • ১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কামিনী রায়কে 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' প্রদান করে সম্মানিত করেন

  • তিনি ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গীয় লিটারারি কনফারেন্সের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন

  • ১৯৩২-৩৩ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেরও সহ-সভাপতি ছিলেন কামিনী রায়

জীবনের শেষ ভাগে তিনি হাজারীবাগে বাস করেছেন২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৩ খ্রীস্টাব্দে তার জীবনাবসান ঘটে


সুকুমার রায় চৌধুরী (৩০ অক্টোবর ১৮৮৭ - ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩)

বাঙালি লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক নাট্যকার হিসেবে পরিচিত সুকুমার রায়সুকুমার রায় চৌধুরী (৩০ অক্টোবর ১৮৮৭ - ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩) ছিলেন একজন বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ভারতীয় সাহিত্যে "ননসেন্স ছড়া" প্রবর্তক তিনি একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার সম্পাদক তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সন্তান এবং তার পুত্র খ্যাতিমান ভারতীয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার লেখা কবিতার বই আবোল তাবোল, গল্প ----, গল্প সংকলন পাগলা দাশু, এবং নাটক চলচ্চিত্তচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা "ননসেন্স" ধরনের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়, কেবল অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড ইত্যাদি কয়েকটি মুষ্টিমেয় ধ্রুপদী সাহিত্যই যাদের সমকক্ষ মৃত্যুর বহু বছর পরেও তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম শিশুসাহিত্যিকদের একজন

রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৪

রায় পরিবারের ইতিহাস থেকে জানা যায় তাঁদের পূর্বপুরুষ শ্রী রামসুন্দর দেও (দেব) অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার চাকদহ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন৷ ভাগ্যাণ্বেষণে তিনি পৈতৃক গ্রাম ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গের শেরপুরে গমন করেন সেখানে শেরপুরের জমিদার বাড়িতে তাঁর সাক্ষাৎ হয় যশোদলের জমিদার রাজা গুণীচন্দ্রের সাথে রাজা গুণীচন্দ্র রামসুন্দরের সুন্দর চেহারা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হন এবং রামসুন্দরকে তাঁর সাথে তাঁর জমিদারিতে নিয়ে যান যশোদলে জমিজমা, ঘরবাড়ি দিয়ে তিনি রামসুন্দরকে তাঁর জামাতা বানান সেই থেকে রামসুন্দর যশোদলে বসবাস শুরু করেন তাঁর বংশধররা সেখান থেকে সরে গিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলায় মসূয়া গ্রামে বসবাস শুরু করেন৷

পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায়, মাতা বিধুমুখী দেবী এবং পাঁচ ভাই-বোনের সাথে সুকুমার রায় এবং তার স্ত্রী সুপ্রভা রায় (১৯১৪)

সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ৩০শে অক্টোবর কলকাতার এক দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ বংশীয় ব্রাহ্ম পরিবারে সুকুমার ছিলেন বাংলা শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পুত্র সুকুমারের মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে তার আদিনিবাস বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলাকটিয়াদি উপজেলার মসূয়া গ্রামে মসূয়াতে বসবাসের আগে তাঁর পূর্বপুরুষের আদিনিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত চাকদহে৷[সুবিনয় রায় সুবিমল রায় তার দুই ভাই ছাড়াও তার তিন বোন ছিল, তারা হলেন সুখলতা, পুণ্যলতা শান্তিলতা

সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে তার পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যানুরাগী, যা তার মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয় পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার শৌখিন জ্যোতির্বিদ উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি সুকুমারকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন এছাড়াও রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসুআচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিল উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন, নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন মেসার্স ইউ. রয় এন্ড সন্স নামে প্রতিষ্ঠানের সাথে সুকুমার যুক্ত ছিলেন

তিনি গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর কলকাতার সিটি স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি. (অনার্স) করার পর সুকুমার মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে যান[সেখানে তিনি আলোকচিত্র মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতাতে ফিরে আসেন

সুকুমার ইংল্যান্ডে পড়াকালীন, উপেন্দ্রকিশোর জমি ক্রয় করে, উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন তিনি ছোটদের একটি মাসিক পত্রিকা, 'সন্দেশ', এই সময় প্রকাশনা শুরু করেন সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয় উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখার সংখ্যা কম থাকলেও উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব সুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায় পিতার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি সন্দেশ  পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন তার ছোটভাই এই কাজে তার সহায়ক ছিলেন এবং পরিবারের অনেক সদস্য 'সন্দেশ'-এর জন্য নানাবিধ রচনা করে তাদের পাশে দাড়ান

সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তার প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ্য করা যায় সন্দেশের সম্পাদক থাকাকালীন তার লেখা ছড়া, গল্প প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে তার বহুমুখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তার অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলোতে তার প্রথম একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার

সাগর যেথা লুটিয়ে পড়ে নতুন মেঘের দেশে

আকাশ-ধোয়া নীল যেখানে সাগর জলে মেশে

মেঘের শিশু ঘুমায় সেথা আকাশ-দোলায় শুয়ে-

ভোরের রবি জাগায় তারে সোনার কাঠি ছুঁয়ে


সুকুমার রায় রচিত ছড়ার অংশবিশেষ


প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়বার সময় তিনি ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন এর মুখপাত্র ছিল সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামের একটি পত্রিকা সেখানেই তার আবোল-তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মানডে ক্লাব (ইংরেজি ভাষা: Monday Club) নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন তিনি মনডে ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা 'জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ' পর্যন্ত সব বিষয়েই আলোচনা করতেন সুকুমার রায় মজার ছড়ার আকারে এই সাপ্তাহিক সভার কয়েকটি আমন্ত্রণপত্র করেছিলেন সেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল মুখ্যত উপস্থিতির অনুরোধ এবং বিশেষ সভার ঘোষণা ইত্যাদি ইংলান্ডে থাকাকালীন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতাও দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তখনও নোবেল পুরস্কার পাননি ইতিমধ্যে সুকুমার লেখচিত্রী/প্রচ্ছদশিল্পীরূপেও সুনাম অর্জন করেছিলেন তার প্রযুক্তিবিদের পরিচয় মেলে, নতুন পদ্ধতিতে হাফটোন ব্লক তৈরি আর ইংল্যান্ডের কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রযুক্তি বিষয়ক রচনাগুলো থেকে

সাংস্কৃতিক সৃজনশীল কার্য ছাড়াও সুকুমার ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠির এক তরুণ নেতা ব্রাহ্ম সমাজ, রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী, অদ্বৈতে বিশ্বাসী হিন্দুধর্মের এক শাখা যারা ৭ম শতকের অদ্বৈতবাদী হিন্দু পুরান ঈশ-উপনিষদ মতাদর্শে বিশ্বাসী সুকুমার রায় 'অতীতের কথা' নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন, যা ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাসকে সরল ভাষায় ব্যক্ত করে - ছোটদের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের মতাদর্শের উপস্থপনা করার লক্ষে এই কাব্যটি একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ওই সময়ের সবথেকে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম ছিলেন, তার ব্রাহ্মসমাজের সভাপতিত্বের প্রস্তাবের পৃষ্ঠপোষকতা সুকুমার করেছিলেন

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে কালাজ্বরে (লেইশ্মানিয়াসিস) আক্রান্ত হয়ে মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে সুকুমার রায় মৃত্যুবরণ করেন, সেই সময় এই রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না তার মৃত্যু হয় একমাত্র পুত্র সত্যজিত এবং স্ত্রীকে রেখে সত্যজিত রায় ভবিষ্যতে একজন ভারতের অন্যতম চলচ্চিত্র পরিচালকরূপে খ্যাতি অর্জন করেন নিজের মৃত্যুর বছর আগে ১৯৮৭ সালে সুকুমার রায়ের উপরে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা করেন

রচনাবলি

আবোল তাবোল, পাগলা দাশু, হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি, খাই-খাই, অবাক জলপান, লক্ষ্মণের শক্তিশেল, ঝালাপালা অনান্য নাটক, , শব্দ কল্প দ্রুম, চলচ্চিত্তচঞ্চরী, বহুরুপী, ভাষার অত্যাচার (১৯১৫, Torture of Language)

হেমেন্দ্রকুমার রায় (প্রকৃত নাম: প্রসাদদাস রায়; জন্ম: ১৮৮৮, মৃত্যূ: ১৮ এপ্রিল ১৯৬৩)

হেমেন্দ্রকুমার রায়  একজন বাঙালি সাহিত্যিক এবং গীতিকারতিনি ছোটদের জন্য রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দা গল্প লেখার জন্য বিখ্যাততার কয়েকটি গল্প উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে

হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জন্মস্থান কলকাতাতার পিতার নাম রাধিকাপ্রসাদ রায়হেমেন্দ্রকুমার রায় মাত্র চৌদ্দ বছর বয়েসে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে বসুধা পত্রিকায় তার প্রথম গল্প 'আমার কাহিনী' প্রকাশিত হয়১৩২২ বঙ্গাব্দে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় এবং মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ভারতী পত্রিকা নতুনরূপে প্রকাশিত হলে হেমেন্দ্রকুমার এর লেখকগোষ্ঠীতে যোগদান করেনসাপ্তাহিক নাচঘর (১৩৩১ বঙ্গাব্দ) পত্রিকাটি তিনি সম্পাদনা করেছিলেনএছাড়া মাসিকপত্র রংমশাল প্রভৃতি কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদনার সাথেও তিনি যুক্ত ছিলেনছোটদের জন্য তিনি ৮০টিরও বেশি বই লিখেছিলেনএর মধ্যে কবিতা, নাটক, হাসি ভূতের গল্প, অ্যাডভেঞ্চার, গোয়েন্দা কাহিনি, ঐতিহাসিক উপন্যাস সবকিছুই ছিলতাঁর সৃষ্ট দুঃসাহসী জুটি বিমল-কুমার, জয়ন্ত (গোয়েন্দা) সহকারী মানিক, পুলিশ ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু, ডিটেকটিভ হেমন্ত, বাংলা কিশোর সাহিত্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য চরিত্র

হেমেন্দ্রকুমার রায় বড়দের জন্যও বেশ কিছু বই লিখেছিলেন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: জলের আলপনা, বেনোজল, পদ্মকাঁটা, ঝড়ের যাত্রী, যাঁদের দেখেছি, বাংলা রঙ্গালয় শিশিরকুমার, ওমর খৈয়ামের রুবায়ত প্রভৃতিতাঁর সিঁদুর চুপড়ি গল্পটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়ে একটি সংকলন গ্রন্থে স্থান পেয়েছিলবিমল কুমারের অভিযান কাহিনি অবলম্বনে তার বিখ্যাত উপন্যাস যকের ধন দুইবার চলচ্চিত্রায়িত হয়

তিনি সফল গীতিকারও ছিলেনসেই সময়ের বাংলা থিয়েটার এবং গ্রামাফোনে গাওয়া গানের প্রচলিত রীতি এবং রুচির মোড় তিনি ফিরিয়েছিলেনতার রচিত অনেক গান সেই সময়ে জনপ্রিয় ছিলঅন্ধকারের অন্তরেতে গানটি এর মধ্যে অন্যতম

তিনি শিশিরকুমার ভাদুড়ির সীতা নাটকের নৃত্য পরিচালক ছিলেনতিনি ভাল ছবি আঁকতে পারতেনবাংলায় শিল্প সমালোচনার তিনি অন্যতম পথিকৃৎ

হেমেন্দ্রকুমার রায় রচিত দেড়শো খোকার কান্ড চলচ্চিত্রায়িত হয় ১৯৫৯ সালেতার লেখা নিশীথিনী বিভীষিকা অবলম্বনে ১৯৫১ সালে বাংলা চলচ্চিত্র জিঘাংসা এবং হিন্দিতে বিশ সাল বাদ (১৯৬২) নির্মিত হয়তার রচনা রাত্রির যাত্রী, যকের ধন টেলিসিরিয়াল আকারে প্রচারিত হয়েছে১৯৩৯ সালে হরিচরন ভঞ্জের পরিচালনায় হেমেন্দ্রকুমারের সর্বাধিক জনপ্রিয় কাহিনী 'যকের ধন' প্রথম চলচ্চিত্রায়িত হয়

কালিদাস রায় (২২ জুন ১৮৮৯২৫ অক্টোবর ১৯৭৫)

কালিদাস রায়  ছিলেন রবীন্দ্রযুগের বিশিষ্ট রবীন্দ্রানুসারী কবি, প্রাবন্ধিক পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা তার রচিত কাব্যগুলির মধ্যে তার প্রথম কাব্য কুন্দ (১৯০৮), কিশলয় (১৯১১), পর্ণপুট (১৯১৪), ক্ষুদকুঁড়া (১৯২২) পূর্ণাহুতি (১৯৬৮) বিশেষ প্রশংসা লাভ করে গ্রামবাংলার রূপকল্প অঙ্কনের প্রতি আগ্রহ, বৈষ্ণবপ্রাণতা সামান্য তত্ত্বপ্রিয়তা ছিল তার কবিতাগুলির বৈশিষ্ট্য তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেছেন

১৮৮৯ সালের জুলাই বর্ধমান জেলার কড়ুই গ্রামে কালিদাস রায়ের জন্ম তিনি ছিলেন চৈতন্যদেবের জীবনীকার লোচনদাসের বংশধর কালিদাসের শৈশব কেটেছিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি শিক্ষকতার বৃত্তি গ্রহণ করেন কলকাতার ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি ১৯৭৫ সালে টালিগঞ্জে 'সন্ধ্যার কুলায়' নামক নিজস্ব বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কালিদাস রায়

১৯১৩ সালে রংপুরের উলিপুর মহারানী স্বর্ণময়ী হাইস্কুলের সহশিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয় পরে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন সাত বছর তারপরে (১৯২০-৩১) দক্ষিণ চবিবশ পরগনার বড়িশা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার ১১ বছর পর রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনের সহায়তায় তিনি কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের ভবানীপুর শাখায় সহকারী প্রধান শিক্ষকরূপে যোগদান করেন এবং ১৯৫২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন 

তিনি রবীন্দ্র-ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে তিনি কাব্যচর্চা শুরু করেন এরপরে কবিতা, ছোটগল্প, রম্য সাহিত্য ইত্যাদি রচনা করেন 'বেতালভট্ট' ছদ্মনামে লিখিত বহু রসরচনা পাঠক সমাজে সমাদৃত

কাব্য

কুন্দ(১৯০৮), পর্ণপূট (১৯১৪ প্রথম খন্ড,১৯২১ দ্বিতীয় খন্ড), ব্রজবেণু(১৯১৫), বল্লরী(১৯১৫), ক্ষুদকুঁড়া(১৯২২), লাজাঞ্জলি(১৯২৪), রসকদম্ব(১৯২৫), হৈমন্তী(১৯৩৬), বৈকালী(১৯৪০), গাথাঞ্জলি(১৯৫৭), সন্ধ্যামণি(১৯৫৮), পূর্ণাহুতি(১৯৬৮), দিন ফুরানোরর গান(১৯৮৪), তথাগত (১৯৯৪)

প্রবন্ধপদাবলী সাহিত্য,

বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়, সাহিত্য প্রসাদ, প্ররাচীন সাহিত্য, শরৎ সাহিত্য

শিশু সাহিত্য

গাথাঞ্জলি(১৯৬১), গাথাকাহিনী(১৯৬৪), তৃণদল(১৯৭০), গাথামঞ্জরী(১৯৭৪), মণীষী বন্দনা(১৯৭৬), গাথাবলী(১৯৭৮)

সাহিত্যকর্মের অবদানের জন্য কালিদাস অনেক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি রংপুর সাহিত্য পরিষদ কবিশেখরউপাধি (১৯২০), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরজগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (১৯৫৩) সরোজিনী স্বর্ণপদক’, বিশ্বভারতীরদেশিকোত্তমউপাধি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারেররবীন্দ্র পুরস্কার’ (১৯৬৩) এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি (১৯৭১) প্রদান করেন

তিনি ১৯৭৫ সালের ২৫ অক্টোবর কলকাতায় মারা যান

আর্টিকেল'টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিবেন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।
গৌরব রায়
বাংলা বিভাগ, 
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ। 
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে : ক্লিক করুন
আরো পড়ুন:
রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৫ ক্লিক করুন
রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৬ ক্লিক করুন
তথ্যসূত্র:
আর্টিকেলের সকল তথ্য উইকিপিডিয়া ও গুগল থেকে নেওয়া!

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.