আগের পর্বগুলো পড়ুন:
রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ১ ক্লিক করুন
রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ২ ক্লিক করুন
মুকুন্দরাম রায়
বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম রাজা মুকুন্দ রাম রায় ছিলেন ভূষণা রাজ্যের একজন প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার । মুকুন্দরামের ভূষণা রাজ্য আজকের মাগুরা জেলার মধুখালী উপজেলা, বৃহত্তর ফরিদপুর ও যশোর জেলার বেশ কিছু অংশ নিয়ে ছিল । মোগল আমলে ভূষণা ছিল সাতৈর পরগনার অধীনে। সম্রাট আকবরের রাজত্বের শেষকালে মীর্জা আজিজ কোকা ও রাজা টোডরমল বাংলাদেশে আসেন বিদ্রোহ দমন করতে । এ সময় মুকুন্দরাম ভূষণা জয় করে নেন। ১৫৮২ সালে রাজা টোডরমল তাকে ভূষণার জমিদার বলে মেনে নেন। পরে তিনি নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। তিনি শুধু নামে কিছু কর পাঠাতেন।আর অধীনতার ভান করতেন।তিনি আসলে স্বাধীন ছিলেন।আকবরের রাজত্বের দিকে তিনি অন্যান্য ভুঁইয়াদের সাথে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ গড়ে তোলেন।
প্রথমে তিনি মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং তিনি তাদের কর দেয়া বন্ধ করেন।এরপর মোঘলদের সংগে যুদ্ধে লিপ্ত হন। প্রতাপাদিত্য বা কেদার রায়ের রাজত্ব সেশ হলেও তিনি দমেন নি।মোঘলদের বিরুদ্ধে তিনি প্রায় সারা জীবন যুদ্ধ করেছেন।
১৫৯৪ খ্রীস্টাব্দে সম্রাট আকবর বাংলার সুবেদার হিসাবে রাজা মানসিংহকে ।সঙ্গে দিয়েছিলেন পাঁচ হাজার সৈন্য। তিনি রাজধানী পৌঁছে বাংলার চর্তুদিকে সৈন্য পাঠান। এ সময় সুবেদার মানসিংহের ছেলে হিম্মত সিংহ বিদ্রোহীদের দমন করতে অগ্রসর হয়। ১৫৯৫ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ফরিদপুরের ভূষণা দখল করেন। ১৫৯৯ খ্রীস্টাব্দে পুনরায় রাজা মানসিংহ সেনাপতি হিম্মত সিংহকে রাজা মুকুন্দ রাম রায়ের সাথে খিজিরপুর যুদ্ধের সময় পাঠান। বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার ফতেহজিৎপুরে(বর্তমান মুকসুদপুর উপজেলাধীন) তাদের ভীষণ লড়াই হয়। এ যুদ্ধে রাজা মুকুন্দরাম রায় মৃত্যুবরণ করেন। মুকুন্দ রায়ের পুত্র রাজা সত্রাজিৎ রায় ।মোগলদের করা ষড়যন্ত্রে রাজা সত্রাজিৎ রায় প্রাণদন্ডে মারা যান। তার বংশের রাজ গৌরব ও স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয় তার মৃত্যুতে।
মথুরাপুর দেউল- ফরিদপুর জেলার মধুখালী শহরে অবস্থিত ।এটি মূলভূমি থেকে প্রায় ৮০ ফুট উচু। এর উপরের অংশটি চাপা।এটি ১২ কোণ ও এক কোঠা বিশিষ্ট । বর্গ আকার ভূমির মাঝখানে এটি অবস্থিত । দেউলের আশেপাশের দেয়াল যুক্ত হয়ে বর্গাকৃতি তৈরি ক্রেছে।এটি ইট নির্মিত।এর গায়ে বিভিন্ন অলংকার, দেব-দেবী, জীব-জন্তুর ছবি অঙ্কিত আছে।এর নির্মাণ কাজ নান্দনিক। দেউলের ভেতরে্র প্রকোষ্ঠ আছে।সেখানে যাবার দু’টি পথ। একটি পশ্চিমে ও অন্যটি দক্ষিণে । দক্ষিণের পথটি সাধারণত তালা মারা থাকে। রাজা মানসিংহ হিম্মত সিংহের শেষ স্মৃতি ও মুকুন্দরামকে স্মরণীয় করতে এই দেউল নির্মাণ করেন।
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (১৭১২ – ১৭৬০)
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও মঙ্গলকাব্যের সর্বশেষ শক্তিমান কবি। হাওড়া জেলার পেড়ো-বসন্তপুরে জন্ম হলেও পরবর্তী জীবনে তিনি নদিয়ার কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের আশ্রয় গ্রহণ করেন। নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় অন্নদামঙ্গল কাব্যের স্বীকৃতিতে তাকে ‘রায়গুণাকর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অন্নদামঙ্গল ও এই কাব্যের দ্বিতীয় অংশ বিদ্যাসুন্দর তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। সংস্কৃত, আরবি, ফারসি ও হিন্দুস্তানি ভাষার মিশ্রণে আশ্চর্য নতুন এক বাগভঙ্গি ও প্রাচীন সংস্কৃত ছন্দের অনুকরণে বাংলা কবিতায় নিপুণ ছন্দপ্রয়োগ ছিল তার কাব্যের বৈশিষ্ট্য। তার কাব্যের অনেক পঙ্ক্তি আজও বাংলা ভাষায় প্রবচনতুল্য। যথাযথভাবেই রবীন্দ্রনাথ তার কাব্যকে তুলনা করেন “রাজকণ্ঠের মণিমালা”-র সঙ্গে। তার আর একটি বিখ্যাত কাব্য সত্যপীরের পাঁচালী। ভারতচন্দ্র ১৭৬০ সালে মৃত্যুবরণ করেন এবং তার মৃত্যুর সাথে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের সমাপ্তি হয়।
ভারতচন্দ্র অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার বর্ধমান জেলার ভুরসুট পরগণার পান্ডুয়া গ্রামে ১৭১২ খ্রিষ্টাব্দে জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের ঔরসে ভবানী দেবীর গর্ভে চতুর্থ তথা কনিষ্ঠ সন্তান রূপে জন্মগ্রহণ করেন। জমির অধিকার সংক্রান্ত বিবাদ সূত্রে নরেন্দ্রনারায়ণ বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্র রায়ের জননীকে কটূক্তি করায় রাজাজ্ঞায় বর্ধমানের সেনাপতি নরেন্দ্রনারায়ণের জমিদারি গ্রাস করে নিলে বাস্তুচ্যূত জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ পালিয়ে যান এবং ভারতচন্দ্র মণ্ডলঘাট পরগনার নওয়াপাড়া গ্রামে মামার বাড়িতে চলে আসেন।
মামা বাড়ির সন্নিহিত তাজপুর গ্রামের টোলে ব্যাকরণ ও অভিধান পাঠের মাধ্যমে তার বিদ্যাশিক্ষার শুরু। চৌদ্দ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় নরোত্তম আচার্যের কন্যার সারদার সঙ্গে। কেবলমাত্র সংস্কৃত শিক্ষা করেছেন বলে তার বড় ভাইয়েরা ভর্ৎসনা করাতে, ভারতচন্দ্র হুগলী জেলার বাঁশবেড়িয়ার নিকট সরস্বতী নদী তীরবর্তী পশ্চিম দেবানন্দপুর গ্রামের রামচন্দ্র মুন্সীর কাছে ফারসি ভাষা শেখেন। এ সময় সত্যনারায়ণ পূজা উপলক্ষে ১৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাত্র পনেরো বছর বয়সে সত্যনারায়ণের পাঁচালী রচনা করেন। তার তিন পুত্রের নাম পরীক্ষিৎ, রামতনু ও ভগবান।
ভারতচন্দ্র আত্মীয়দের পরামর্শে মোক্তার হিসেবে বর্ধমানে যান ও তার পিতার ইজারা গৃহীত জমি দেখাশোনা করেন। কিন্তু তার ভাইয়েরা নিয়মিত করপ্রেরণে অপারগ হলে বর্ধমানের রাজা ঐ জমিটি খাসভুক্ত করে নেন। এতে ভারত আপত্তি করায় তাকে কারাগারে আবদ্ধ করা হয়। কিছুদিনের মধ্যে কারারক্ষকের দয়ায় তিনি গোপনে মারহাট্টা শাসিত কটকে পালিয়ে সুবেদার শিবভট্টর কাছে আশ্রয় লাভ করেন।
ভারতচন্দ্র শিবভট্টর কাছে নিজের সব ঘটনা খুলে বলেন ও পুরীধামে কিছুদিন বাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দয়াশীল সুবেদার তার কর্মচারী, মঠের আধিকারিক ও পান্ডাদের নির্দেশ দেন, উনি যতদিন শ্রীক্ষেত্রে থাকতে চান, ততদিন উনার কাছ থেকে যেন কোনরকম কর না চাওয়া হয়। যখন যে মঠে ইচ্ছা উনি থাকতে পারবেন। ভারতচন্দ্র এবং উনার ভৃত্যের আহারের জন্য প্রতিদিন একটি বলরামী আটকের ব্যাবস্থা করেন উনি।
নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের অনুরোধে ভারত কৃষ্ণনগর গেলে রাজা তাকে চল্লিশ টাকা বেতন ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেন। তার আদেশে ভারতচন্দ্র ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর রচনা প্রণালীতে অন্নদামঙ্গল রচনা করতে শুরু করেন। একজন ব্রাহ্মণ তার রচনা লিখে রাখেন ও নীলমণি সমাদ্দার নামে এক গায়ক তাতে সুর দেন। এরপরে রাজার আদেশে তিনি বিদ্যাসুন্দর রচনা করেন। বিদ্যাসুন্দর রচনার পরে ভারতচন্দ্র রসমঞ্জরী পুস্তকটি রচনা করেন। এছাড়াও সত্যপীরের কথা, নাগাষ্টক, ইত্যাদি রচনা করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাকে গুনাকর (গুণে আকর) উপাধি প্রদান করেন। এরপরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ভারতচন্দ্রকে চব্বিশ পরগনার মূলাযোড় (অধুনা শ্যামনগর) গ্রামে বাস করবার জন্য ছয়শ টাকা বার্ষিক রাজস্ব নির্দিষ্ট করে গ্রামখানি ইজারা দেন।
রামমোহন রায় (মে ২২, ১৭৭২ – সেপ্টেম্বর ২৭, ১৮৩৩)
রামমোহন রায়, অথবা রাজা রাম মোহন রায় লেখা হয় রাজা রামমোহন রায় (মে ২২, ১৭৭২ – সেপ্টেম্বর ২৭, ১৮৩৩) প্রথম ভারতীয় ধর্মীয়-সামাজিক পুনর্গঠন আন্দোলন ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা সমাজসংস্কারক, ধর্মসংস্কারক, চিন্তাবিদ, বহুভাষাবিদ পণ্ডিত এবং বাঙালি দার্শনিক। তৎকালীন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্মীয় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখতে পেরেছিলেন। তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন, সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টার জন্য। তখন হিন্দু বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতে বা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করা হত।
রামমোহন রায় কলকাতায় আগস্ট ২০, ১৮২৮ সালে ইংল্যান্ড যাত্রার আগে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে এই ব্রাহ্মসমাজ এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন এবং বাংলার পুনর্জাগরণের পুরোধা হিসাবে কাজ করে।
মে ২২, ১৭৭২ সালে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন এক সম্ভ্রান্ত ও ব্রাহ্মণ পরিবারে। প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত ফারুখশিয়ারের আমলে বাংলার সুবেদারের আমিনের কার্য করতেন। সেই সূত্রেই 'রায়' পদবীর ব্যবহার বলে অনুমান করা হয়। কৃষ্ণকান্তের কনিষ্ঠ পুত্র ব্রজবিনোদ রামমোহনের পিতামহ। পিতা রামকান্ত। রামকান্তের তিন বিবাহ। মধ্যমা পত্নী তারিণীর এক কন্যা ও দুই পুত্র : জগমোহন ও রামমোহন। এঁদের বংশ ছিল বৈষ্ণব, কিন্তু রামমোহনের মাতা ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক ঘরের কন্যা। রামকান্ত পৈতৃক এজমালি ভদ্রাসন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী লাঙ্গুলপাড়া গ্রামে স্ব-পরিবারে উঠে যান। তার পিতা রামকান্ত রায় ছিলেন বৈষ্ণবী এবং মাতা তারিণী দেবী ছিলেন শাক্ত। পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানা স্থানে ঘোরেন। কাশীতে ও পাটনায় কিছুকাল ছিলেন এবং নেপালে গিয়েছিলেন। এর আগে তার সঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রবেত্তা সুপণ্ডিত নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের (পরে হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী কুলাবধূত নামে পরিচিত) যোগাযোগ হয়। রামমোহনের সংস্কৃতে বুৎপত্তি, তার বেদান্তে অনুরাগ নন্দকুমারের সহযোগিতায় হয়েছিল। ব্রাহ্ম উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় হরিহরানন্দই তার দক্ষিণ-হস্ত ছিলেন। বারাণসী থেকে প্রথাগত সংস্কৃত শিক্ষার পর তিনি পাটনা থেকে আরবি ও পারসি ভাষা শেখেন। পরে তিনি ইংরেজি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষাও শেখেন।
তরুণ বয়সে তিনি কলকাতায় মহাজনের কাজ করতেন। ১৭৯৬ সালে রামমোহন অর্থোপার্জন শুরু করেন। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। কলকাতায় প্রায়ই আসতেন এবং কোম্পানির নবাগত অসামরিক কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাদের নানা বিষয়ে সাহায্য করেন। এই সুযোগে ভালো করে ইংরেজি শিখে নেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজে সিভিলিয়ান কর্মচারীদের মধ্যে জন ডিগবির সঙ্গে তার সর্বাধিক ঘনিষ্ঠতা হয়। কোম্পানির কাজে ডিগবির অধীনে তিনি দেওয়ানরূপে রংপুরে কাজ করেন ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে তিনি দু'বার ভুটান সীমান্তে যান কোম্পানির হয়ে দৌত্যকার্যে ডিগবির সাহচর্যে তার সমস্ত নতুন চিন্তা এই সময়ের মধ্যেই পরিপক্কতা লাভ করে। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে রামমোহন কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন, এখন থেকেই প্রকাশ্যে তার সংস্কার-প্রচেষ্টার শুরু।
তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় লেখা (ভূমিকা অংশ আরবিতে) তুহফাতুল মুহাহহিদিন। বইটিতে একেশ্বরবাদের সমর্থন আছে। এরপর একেশ্বরবাদ (বা ব্রাহ্মবাদ) প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত-সূত্র ও তার সমর্থক উপনিষদগুলি বাংলার অনুবাদ করে প্রচার করতে থাকেন। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত হয় বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও মুণ্ডকোপনিষদ। রক্ষণশীল ব্যক্তিরা ক্রুদ্ধ হয়ে তার লেখার প্রতিবাদ দেখাতে লাগলেন। এই সব প্রতিবাদ কটূক্তিপূর্ণ এবং বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। রামমোহনও প্রতিবাদের প্রতিবাদ করলেন যুক্তি দিয়ে ও ভদ্রভাষায়। প্রতিবাদ-কর্তারা অবিলম্বে থেমে গিয়েছিলেন। প্রতিবাদ-কর্তাদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, এঁর গ্রন্থের নাম 'বেদান্তচন্দ্রিকা'। বেদান্তচন্দ্রিকা'র প্রতিবাদে রামমোহন ভট্টাচার্যের সহিত বিচার লিখে প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। 'বেদান্ত গ্রন্থ' প্রকাশের সঙ্গে তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ একেশ্বর উপাসনার পথ দেখালেন আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করে। এই আত্মীয় সভাকেই পরে তিনি ব্রাহ্মসমাজ নাম ও রূপ দেন। সাহেবদের বাংলা শেখানোর জন্য তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে ব্যাকরণ রচনা করেন।
বেদান্ত-উপনিষদগুলি বের করবার সময়ই তিনি সতীদাহ অশাস্ত্রীয় এবং নীতিবিগর্হিত প্রমাণ করে পুস্তিকা লিখলেন 'প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ'। প্রতিবাদে পুস্তিকা বের হল 'বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ'। তার প্রতিবাদে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুস্তিকা বের হয়। এই বছরেই ডিসেম্বর মাসে আইন করে সহমরণ-রীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তবুও গোঁড়ারা চেষ্টা করতে লাগল যাতে পার্লামেন্টে বিষয়টি পুনর্বিবেচিত হয়। এই চেষ্টায় বাধা দেওয়ার জন্য রামমোহন বিলেত যেতে প্রস্তুত হলেন। এব্যাপারে তাকে আর্থিক সহায়তা দান করেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। মোঘল সম্রাট ২য় আকবর তার দাবি ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করার জন্য ১৮৩০ সালে রামমোহনকে বিলেত পাঠান, তিনি রামমোহনকে রাজা উপাধি দেন।
বেদান্তচন্দ্রিকার প্রতিবাদে রামমোহন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিচার লিখে প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বেদান্ত গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ একেশ্বর উপাসনার পথ দেখান আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করে। এই আত্মীয় সভাকেই পরে তিনি ব্রাহ্মসমাজ নামে নতুন রূপ দেন।
১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর তিনি কলকাতা থেকে বিলেত যাত্রা করেন। দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর তাকে 'রাজা' উপাধি দিয়ে ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে কিছুদিনের জন্য তিনি ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের সমাজ সংস্কারের অন্যতম পথিকৃত্।
রামমোহন রায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন। তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মূর্তি পূজার বিরোধী ছিলেন। এই বিশ্বাস থেকে তিনি ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। রামমোহন রায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আচরণীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মানতেন না ও তা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতেন। তিনি মনে করতেন সকল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। রামমোহন রায় বেদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে তার বক্তব্য প্রমাণ করেন।
রামমোহন রায় ১৮৩১ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের দূত হিসেবে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেন, তিনি ফ্রান্সও পরিদর্শন করেছিলেন। ১৮৩৩ সালে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ব্রিস্টলের কাছে স্টেপল্টনে মৃত্যুবরণ করেন। ব্রিস্টলে আর্নস ভ্যাল সমাধিস্থলে তাকে কবর দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে মধ্য ব্রিস্টলে তার একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৯ জুলাই ১৮৬৩ - ১৭ মে ১৯১৩)
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি, নাট্যকার ও সংগীতস্রষ্টা। তিনি ডি. এল. রায় নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রায় ৫০০ গান রচনা করেন।এই গানগুলি বাংলা সংগীত জগতে দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত গান "ধনধান্যে পুষ্পে ভরা", "বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ" ইত্যাদি আজও সমান জনপ্রিয়। তিনি অনেকগুলি নাটক রচনা করেন। তাঁর নাটকগুলি চার শ্রেণিতে বিন্যস্ত: প্রহসন, কাব্যনাট্য, ঐতিহাসিক নাটক ও সামাজিক নাটক। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে জীবদ্দশায় প্রকাশিত আর্যগাথা : ছাত্রাবস্থায় প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ (১ম ও ২য় ভাগ) ও মন্দ্র বিখ্যাত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার-পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে।তাঁর পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় (১৮২০-৮৫) ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান।সে বাড়িতে বহু গুণীজনের সমাবেশ হত। কার্তিকেয়চন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক। এই বিদগ্ধ পরিবেশ বালক দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়। তাঁর মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। দ্বিজেন্দ্রলালের দুই দাদা রাজেন্দ্রলাল ও হরেন্দ্রলাল এবং এক বৌদি মোহিনী দেবীও ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যস্রষ্টা।
দ্বিজেন্দ্রলাল ১৮৭৮-এ প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। এফ. এ. পাস করেন কৃষ্ণনগর গভঃ কলেজ থেকে। পরে হুগলি কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এম.এ. পাস করেন। এরপর কিছুদিন ছাপরার রেভেলগঞ্জ মুখার্জ্জি সেমিনারিতে শিক্ষকতা করার পর সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে যান কৃষিবিদ্যা শিক্ষা করার জন্য। রয়্যাল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি হতে কৃষিবিদ্যায় FRAS এবং MRAC ও MRAS ডিগ্রি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ Lyrics of Ind। এই বছরই দেশে প্রত্যাবর্তন করে সরকারি কর্মে নিযুক্ত হন দ্বিজেন্দ্রলাল। কিন্তু তিন বছর বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরে প্রায়শ্চিত্ত করতে অসম্মত হলে তাকে নানা সামাজিক উৎপীড়ন সহ্য করতে হয় সংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু সমাজ দ্বারা।
ভারতবর্ষে ফিরে তিনি জরিপ ও কর মূল্যায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং মধ্যপ্রদেশে সরকারি দপ্তরে যোগ দেন। পরে তিনি দিনাজপুরে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পান। তিনি প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আন্দুলিয়া নিবাসী প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীকে বিবাহ করেন ১৮৮৭ সালে। ১৮৯০ সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুতা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসার হিসাবে কর্মরত অবস্থায় কৃষকদের অধিকার বিষয়ে তাঁর সাথে বাংলার ইংরেজ গভর্নরের বিবাদ ঘটে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ১৯১৩ সালে সরকারি চাকরি হতে অবসর নেন।
দ্বিজেন্দ্রলালের দুই অগ্রজই ছিলেন লেখক ও পত্রিকা সম্পাদক। গৃহে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের যাতায়াত ছিল। এরকম একটি পরিবেশে কৈশোরেই তিনি কবিতা রচনা শুরু করেন। ১৯০৫ সালে তিনি কলকাতায় পূর্ণিমা সম্মেলন নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালে তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। অল্প বয়স থেকেই কাব্য রচনার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে আর্যগাথা (১ম ও ২য় ভাগ) ও মন্দ্র বিখ্যাত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি। দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্যে তাঁর দেশপ্রেমের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। পাঠান-মুঘল সম্রাটদের বিরুদ্ধে দেশের ভারতীয় মানুষের স্বাধীনতার লড়াইয়ের মর্মস্পর্শী বিবরণ বার বার তাঁর নাটকগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে।
হাস্যরসেও তিনি অসামান্য পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন:
স্ত্রীর চেয়ে কুমীর ভাল বলেন সর্বশাস্ত্রী!
ধরলে কুমীর ছাড়ে বরং, ধরলে ছাড়ে না স্ত্রী।
কাব্যগ্রন্থ :
আর্যগাথা, ১ম খণ্ড (১৮৮৪), The Lyrics of India (ইং থাকাকালীন রচিত) (১৮৮৬ ), আর্যগাথা, ২য় খণ্ড (১৮৮৪), আষাঢ়ে (১৮৯৯), হাসির গান (১৯০০), মন্দ্র (১৯০২), আলেখ্য (১৯০৭), ত্রিবেণী (১৯১২)
উল্লেখযোগ্য নাটক :
(১) প্রহসন বা লঘু রসাশ্রয়ি নাটক
একঘরে (১৮৮৯), কল্কি অবতার (১৮৯৫), বিরহ (১৮৯৭), এ্যহস্পর্শ বা সুখী পরিবার (১৯০১), প্রায়শ্চিত্ত (১৯০২), পুনর্জন্ম (১৯১১), আনন্দ-বিদায় (১৯১২) •
(২) ইতিহাসাশ্রয়ী নাটক-
তারাবাঈ (১৯০৩)(প্রথম ঐতিহাহাসিক নাটক), রানা প্রতাপসিংহ (১৯০৫), দুর্গাদাস (১৯০৬), সোরার রুস্তম (১৯০৮), নূরজাহান (১৯০৮), মেবার পতন (১৯০৮), সাজাহান (১৯০৯)(সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক)
চন্দ্রগুপ্ত (১৯১২), সিংহল বিজয় (১৯১৫) •
(৩) পৌরাণিক নাটক-সম্পাদনা
পাষাণী (১৯০০)(প্রথম পৌরাণিক নাটক), সীতা (১৯০৮)(শ্রেষ্ঠ পৌরাণিক নাটক), ভীষ্ম (১৯১৪)
(৪) সামাজিক নাটক-সম্পাদনা
পরপারে (১৯১২), বঙ্গনারী (১৯১৬)
১৯১৩ সালের ১৭ই মে তারিখে কলকাতায় দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনাবসান ঘটে।

.png)