শ্রীমঙ্গল উপজেলার তথ্যাদি: পার্ট-২; শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রাচীন ও মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস বলো? শ্রীমঙ্গল উপজেলার নামকরণের ইতিহাস বলো?

৭. শ্রীমঙ্গল নামকরণের ইতিহাস বলো?

দু’টি পাতা একটি কুঁডির দেশ শ্রীমঙ্গল । দু’শ  বছরের প্রাচীন শ্রীমঙ্গল শহরের নামকরণ নিয়ে ভিন্ন - ভিন্ন কাহিনী শোনা গেলেও রেকর্ডপত্রে লিপিবদ্ধ আছে- ’শ্রীদাস’ ও ‘মঙ্গলদাস’ নামে প্রতাপশালী বিত্তবান দুই ভাই প্রথমে এসে এখানে হাইল হাওর তীরে বিশাল এলাকাজুড়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন । পরবর্তীতে শ্রীদাস , মঙ্গলদাসের এলাকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং এক সময় এ দু’ভাইয়ের নামানুসারে শ্রীমঙ্গল নামকরণ করা হয় এ এলাকার । 

আরেক মহল থেকে বলা হয়েছে , শ্রীমঙ্গল শহরের অদূরে ‘ মঙ্গলচন্ডী ' দেবতার একটি স্থলী ছিল । তার নামানুসারে ‘ শ্রীমঙ্গল ’ নামকরণ করা হয়েছে ।

শ্রীমঙ্গলের নামকরণ সম্পর্কে সবথেকে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ধরা হয় বাবু প্রকৃত রঞ্জন দত্ত ( এডভোকেট হাই কোর্ট ডিভিশন সিলেট ) বিরচিত ‘ ‘সাঁতগাও এর ইতিহাস’ – নিবন্ধেএতে বিভিন্ন লেখকের মত ও সূত্রের উদ্ধৃতিসহ বর্ণনা করেছেন যে , সাতগাঁও এর পাহাড়ে অধিষ্ঠিত শ্রীমঙ্গল চন্ডি মন্দিরকে কেন্দ্র করে এককালে মঙ্গল চন্ডির হাটের প্রতিষ্ঠা হয় । সেই মঙ্গল চন্ডির হাটই পরবর্তী কালে শ্রীমঙ্গল বাজারে রূপান্তরিত হওয়ার পর এ অঞ্চলে অধিক লোক সমাগম ঘটে এবং লোকমুখে শ্রীমঙ্গল বাজার হিসেবে এ অঞ্চল পরিচিতি লাভ করে । এখানে উল্লেখযোগ্য যে , শ্রীমঙ্গল চন্ডির মন্দিরের বিলুপ্ত প্রায় ধ্বংসাবশেষ রযেছে বর্তমান শ্রীমঙ্গল পৌরসভা হতে কযেক ক্রোশ উত্তর পশ্চিমে । 

৮. শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রাচীন ও মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস বলো? 

ইতিহাস কয়েকটি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে ; যেমন :

  • প্রাচীন রাজ্য সমূহ ;

  • আর্য যুগ;

  • মুসলিম শাসিত আমল;

  • মোগল আমল;

  • ব্রিটিশ আমল;

  • পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্তি;

  • মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ

বর্ণিত আছে যে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল , পৌরাণিক যুগে প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল । ঐ যুগে সিলেটের লাউড় পর্বত কামরূপ রাজ্যের উপ - রাজধানী ছিল বলে জানা যায় । ধারণা করা হয় প্রাচীনকালে দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল । দশম শতাব্দিতে এ অঞ্চলের কিছু অংশ বিক্রমপুরের চন্দ্রবংশীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত হয় বলে জানা যায় । 

১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চল মুসলমানদের দ্বারা অধিকৃত হয় এবং ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে আউলিয়া শাহ জালাল ( রহ :) দ্বারা গৌড় রাজ্য বিজিত হলে , দিল্লীর সুলতানদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় । চতুর্দশ শতাব্দিতে বালিশিরা (শ্রীমঙ্গল) অঞ্চলের ত্রিপুরার মহারাজা রাজত্ব করতেন । অর্থাৎ ঐ সময় শ্রীমঙ্গল ছিলো ত্রিপুরার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ । প্রবল শক্তিশালী এ রাজার বিরুদ্ধে কুকি সামন্ত রাজা প্রায়ই বিদ্রোহ ঘোষণা করতেন। এরকম এক যুদ্ধে ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান শ্রীমঙ্গলের বালিশিরা পরগনার শংকরসেনা গ্রামে মহারাজের প্রধান সেনাপতি ( মহারাজের দামান ) নিহত হলে মহারাজের মেয়ে সতীদাহে রাজি না হয়ে আরাধনা শুরু করেন । ঐ যুদ্ধের স্থানেই নিম্মাই শিববাড়ি নির্মিত হয় । উল্লেখ্য বর্তমানে নির্মাই শিববাড়ি শ্রীমঙ্গলের বালিশিরা পরগনার শংকরসেনা গ্রামে রয়েছে । 

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভাগ্যচন্দ্রের শাসনামলে মনিপুর রাজপুরুষ মারাংখেম গোবিন্দের নেত্বত্বে একদল মণিপুরী মণিপুর রাজ্য ছেড়ে শ্রীমঙ্গলের খাসপুরে এসে আবাস গড়েন । এই খাসপুরে রয়েছে মোরাংশেম গোবিন্দের স্মৃতিস্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ । ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের মালনিছড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম চা - বাগান । এরপর শ্রীমঙ্গলে বিপুল পরিমানে চা - বাগান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকায় বিস্তৃত হয় চায়ের ভূবন।

ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকে বৃহত্তর সিলেট জেলা সহ শ্রীমঙ্গল ঢাকা বিভাগের অধীনে ছিল । ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চল ভারতের আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর শ্রীমঙ্গলসহ বৃহত্তর সিলেট জেলাকে আবার ঢাকা বিভাগের অধীনে নিয়ে যাওয়া হয় । ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পর পুনরায় বৃহত্তর সিলেটসহ শ্রীমঙ্গল আসামের অর্ন্তভুক্ত করা হয় । অর্থাৎ টানা দুইবার ঢাকা বিভাগ ও দুইবার আসামের অন্তর্ভুক্ত করা হয় । ১৮৮২ সালে মৌলভীবাজারকে সাউথ সিলেট মহকুমা ঘোষণা করা হয় এবং ১৯১২ সালে শ্রীমঙ্গলকে থানা ঘোষণা করা হয় । ১৯১৫ সালে আসাম সরকারের এক নির্দেশে লোকাল বোর্ড চালু হলে শ্রীমঙ্গলকে মৌলভীবাজার লোকাল বোর্ড এর অধীনে ন্যাস্ত করা হয় । এই এলাকায় চা - চাষের উপযোগী ভূমি থাকায় এখানে চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয় । চা - পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য এই অঞ্চলে রেল লাইন স্থাপিত হয় । প্রথম শ্রেনীর মর্যাদা দিয়ে শ্রীমঙ্গল রেল স্টেশনের গোড়াপত্তন করা হয় । শ্রীমঙ্গল রেল স্টেশন প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে থানা সদর দপ্তর শ্রীমঙ্গলে স্থানান্তরিত হয় । ১৯২৯ সালে শ্রীমঙ্গল বাজার এলাকাকে আরবান এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় । ১৯৩৫ সালের ১ লা অক্টোবর , ১৯২৩ এর আসাম মিউনিসিপ্যাল এ্যাক্ট এর বিধান মূলে ১৯২৯ সালে ঘোষিত আরবান এলাকা নিয়ে শ্রীমঙ্গল স্মল টাউন কমিটি গঠিত হওয়ার মাধ্যমে শ্রীমঙ্গল পৌরসভার আত্নপ্রকাশ ঘটে । ১৯৬০ সালে এটি ‘ মিউনিসিপ্যালিটিতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৬৩ সালে বালিশিরা কৃষক বিদ্রোহ চলাকালে পুলিশের গুলিতে উপজেলার ২ জন কৃষক নিহত হন। 

১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর অসহযোগ আন্দোলন শ্রীমঙ্গলে তীব্র রূপ নেয় । ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিলের পর থেকে পাকিস্তান হানাদারবাহিনী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রীমঙ্গলে হত্যা করেছিল ৫০ এরও অধিক মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য নারী পুরুষদের । শ্রীমঙ্গলের ফিনলে টি কোম্পানির ভাড়াউড়া চা বাগান এলাকায় বধ্যভূমিতে ৪৭ জন চা - শ্রমিককে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি ছুঁড়ে হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী । তারপর থেকে শ্রীমঙ্গলের চা শিল্পসহ অফিস আদালতে সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা । ভাড়াউড়া চা বাগানে কলেজ রোডের পাশে নির্মিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিসৌধ এখনও সেই করুন ইতিহাস নিযে দন্ডায়মান রয়েছে । পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শ্রীমঙ্গলে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মুকিত লস্কর । এরপর একে একে শহীদ আনিস মিয়া ( রিক্সা চালক ) , ছাত্রলীগ নেতা শহীদ মইনউদ্দিন , শহীদ শম্ভু ভূমিজ , শহীদ সমীর সোম , শহীদ আব্দুস শহীদ , শহীদ সুখময় পাল , শহীদ সুদর্শন , শহীদ আলতাফুর রহমান আরো অনেকেই । এছাড়া পাকবাহিনী পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে তাদের শেষ নির্যাতনের শিকার হন চা - শ্রমিক নেতা ও চা - শ্রমিকদের মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট পবন কুমার তাঁতী । পাক - হানাদার বাহিনী পবনকে হত্যা করে ওয়াবদার পাশে ভুরভুরিয়া ছড়ায় তার লাশ ফেলে যায় । এ ছাড়া শ্রীমঙ্গল পৌর শহরের হবিগঞ্জ রোডের ওয়াবদার অফিসের পিছনে একটি ছড়ায় ও বর্তমান বিজিবি সেক্টরের সাধু বাবার বটতলা খ্যাত ( বর্তমান নাম : বধ্যভূমি -৭১ ) বেশ কয়েকটি স্থানে পাক বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছিল । আর সেখানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বীর মুক্তিযােদ্ধা শহীদ নিকুঞ্জ সেল , সমীর সোম ও অর্জুন দাসসহ বহু বীরসেনানীকে । মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই ও ভারতের সীমান্ত থেকে মুক্তি বাহিনী ক্রমশ ক্যাম্প অভিমুখে এগিয়ে আসার খবরে পাক বাহিনী ভীত হয়ে পড়ে । অবস্থার বেগতিক দেখে ৬ ডিসেম্বর ভোরবেলা তারা পালিয়ে মৌলভীবাজারে আশ্রয় গ্রহণ করে । এর মাধ্যমেই মুক্ত হয় শ্রীমঙ্গল শহর । 

শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে শ্রীমঙ্গলে সাধু বাবার বটতলার পাশে ( বিজিবি ক্যাম্পের পাশে ) ২০১০ সালের ১০ ডিসেম্বর মাসে নির্মাণ করা হয় বধ্যভূমি -৭১ নামের একটি স্মৃতিস্তম্ভ। ১৯৭২ সালের ৫ মে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতির ঘোষণা বলে শ্রীমঙ্গল পৌরসভা গঠিত হয় । ১৯৯৪ সালের ১ জুলাই পৌরসভাটি দ্বিতীয় শ্রেণীতে এবং ২০০২ সালের ১ জুলাই প্রথম শ্রেনিতে উত্তীর্ণ হয় । 

আর্টিকেল'টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিবেন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।
গৌরব রায়
বাংলা বিভাগ, 
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ। 
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে : ক্লিক করুন

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.