রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ১

চাঁদ রায় (পনেরো শতক) 

চাঁদ রায় বিক্রমপুরের একজন জমিদার তিনি পনেরো শতকের গোড়ার দিকে কর্নাট থেকে বিক্রমপুরের আরা ফুলবাড়িয়ায় এসে বসতি স্থাপনকারী জনৈক নিম রায়ের বংশধর বলে কথিত নিম রায় ছিলেন কায়স্থ হিন্দু সম্ভবত তিনিই ছিলেন বংশের প্রথম ভূঁইয়া এবং পুরুষানুক্রমেভূইয়াউপাধি ধারণের সপক্ষে তৎকালীন শাসকের মঞ্জুরিও তিনি লাভ করেছিলেন

জনশ্রুতি পৌরাণিক লোককাহিনী চাঁদ রায়ের পরিচয়কে বিতর্কিত করে তুলেছে শ্রীপুরের জমিদারীতে তাঁর অবস্থান অস্পষ্ট তাঁকে বিক্রমপুরের জমিদাররূপে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ধারণা করা হয় তাঁর রাজধানী ছিল শ্রীপুর অথচ প্রায়শ কেদার রায়কে তুলে ধরা হয়েছে জমিদারীর যৌথ-প্রশাসক হিসেবে জমিদার হিসেবে তাঁর কার্যকাল এবং তাঁর উত্তরাধিকারী কেদার রায়ের কার্যকালের বিস্তৃতি সম্পূর্ণ অস্পষ্ট আবার কেউ কেউ বলেন, চাঁদ রায় কেদার রায়ের পিতা, পিতৃব্য, কেউ বলেন ভ্রাতা, আবার কেউ তাঁকে শনাক্ত করেছেন কেদার রায়ের পুত্র রূপে সম্ভবত তিনি যাদব রায়ের পুত্র এবং কেদার রায়ের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা চাঁদ রায় মুগল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবং আরাকানিদের ঝটিকা আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে বীরত্বের পরিচয় দেন ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে চাঁদ রায় কেদার রায় আফগান নেতা খাজা সুলায়মান লোহানীর সহযোগিতায় মুগল অধিকৃত ভূষণা দুর্গ দখল করেন দুর্গ অবরোধকালে প্রথম পর্যায়ের সংঘর্ষেই চাঁদ রায় নিহত হন

কেদার রায় (পনেরো শতক) 

বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম হল ভ্রাতৃদ্বয় কেদার রায় চাঁদ রায় কেউ কেউ কেদার রায়কে শ্রেষ্ঠ ভুঁইয়া বলেছেন এবং মহারাজ প্রতাপাদিত্যের থেকেও অধিক বীর চরিত্রবান বলেছেন| তিনি বিক্রমপুরের জমিদার

প্রতাপের মতো কুলীন না হওয়ার ফলে (তারাদেউপাধিধারী ছিলেন) এই কায়স্থদ্বয়ের বিবরণঘটককারিকাতে পাওয়া যায় না৷ একই কারণে এমন আরও অনেক বীর হয়তো ইতিহাসে স্থান পায় নি শাসন বীরত্বের জন্য তাদের প্রভূত খ্যাতি ছিল| তিনি সম্ভবত পনেরো শতকের গোড়ার দিকে সেন আমলে কর্ণাটক থেকে এসে বিক্রমপুরের আড়া ফুলবাড়িয়ায় বসতি স্থাপনকারী, রাজকর্মচারী জনৈক নিম রায়ের বংশধর নিম রায় ছিলেন কায়স্থ হিন্দু সম্ভবত তিনিই ছিলেন বংশের প্রথম ভুঁইয়া এবং পুরুষানুক্রমে ভুঁইয়া উপাধি ধারণের সপক্ষে তৎকালীন শাসকের মঞ্জুরিও তিনি লাভ করেছিলেন নিম রায়ের ষষ্ঠ পুরুষ যাদব রায়ের দুই পুত্র কেদার চাঁদ তারই বংশোদ্ভূত

তার কয়েক জন কন্যা ছিল কেদার রায়কে পরাজিত করে তার এক কন্যার পাণিগ্রহণ করে মান সিংহ৷ এই ভ্রাতৃদ্বয়ের রাজধানী ছিল ঢাকার শ্রীপুর বা বিক্রমপুর (বর্তমানে দক্ষিণ বিক্রমপুর তথা শরীয়তপুর জেলা৷ যা মুন্সিগঞ্জের দীঘিরপাড় ইউনিয়নের দক্ষিণে নদীতে বিলীন যা ছিল কালীগঙ্গা নদীর তীরবর্তী৷  চাঁদ রায় তার ভাই কেদার রায় শাসন করতেন পদ্মার দুইপারের বিস্তীর্ণ জনপদ শ্রীপুর ছিল তাদের রাজধানী বিক্রমপুর, ইদ্রাকপুর , ইদিলপুর, কেদারপুর, চাঁদপুরের বৃহৎ অংশ জুড়ে ছিল তাদের রাজত্ব এই ইদিলপুরই এখন বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলা কিছুকাল আগেও এটি বৃহত্তর মাদারিপুরের অধীনে ছিল কালীগঙ্গা নদীর বুক দিয়ে পদ্মানদী প্রবাহিত হওয়ার পরে কেদার রায়ের স্মৃতিবিজড়িত সিংহভাগই কীর্তিনাশা বা পদ্মা নদীতে ভেসে গেছে, কেদার রায়ের রাজধানী শ্রীপুরের শেষচিহ্ন ১৯২৩ সালে নদীতে বিলীন হয় শ্রীপুরের দক্ষিণে চন্ডিপুর অঞ্চল এখানে ছিল কেদার রায়ের সবচেয়ে বড় যুদ্ধকুঠি, যা পর্যায়ক্রমে নদীতে বিলীন হয়ে যায় মোগল বাহিনীর থেকে বিক্রমপুরের স্বাধীনতা বজায় রাখতে আরও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে শ্রীপুরে কয়েক মাইল দক্ষিণে কেদারপুরে তিনি প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেন , যা সমাপ্ত হওয়ার আগেই বর্তমান নড়িয়া উপজেলার ফতেহ্জঙ্গপুরে মোগলদে সাথে চতুর্থ যুদ্ধে কেদার রায় নিহত হন তার স্মৃতিচিহ্নকে কেন্দ্র করেই ফতেহ্জঙ্গপুর কেদারপু গ্রামের নামকরণ হয়, যে স্মৃতিচিহ্ন এখনো বিরাজমান রয়েছে মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ী উপজেলার দীঘিরপাড় ইউনিয়নটিও তার খনন করা কেশার মায়ের দীঘিকে কেন্দ্র করে পদ্মানদীর উত্তরপাড়ে টিকে আছে

রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ১

শরীয়তপুরের একটি গ্রাম রায়পুর বাংলার বারোভূঁইয়াদের একজন কেদার রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গ্রামটি তাদের রায়বংশ অনুসারেই নাম হয়েছিল রায়পুর যা কয়েক শতাব্দী ধরে ছিল সেই গ্রামের নাম এখন পুটিজুরি আজ আর চাঁদ রায়, কেদার রায়দের কোন চিহ্নমাত্র নেই সেখানে শুধু পাশের গ্রামে তাদের খনন করা দুটি বিশাল দীঘি রয়ে গেছে এখনো দিগম্বরী দেবীর পূজা হয় সেখানে তাই এই দিঘীগুলোর বর্তমান নাম দিগম্বরীর দীঘি শুধু এই দীঘি দুটিই পদ্মার এপারে বারোভূঁইয়া কেদার রায়কে মনে রেখেছে কেদার রায়ের খনন করা দিগম্বরীর দিঘির একটু দূরেই এখনও কিছু পোড়া ইট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাড়ি সেখানে এখন অন্য লোকের বসতি স্থানীয় লোকেরা বাড়িটাকে বলেভিয়া বাড়ি আসলেভুঁইয়া বাড়িমানুষের মুখে মুখে অপভ্রংশ হতে হতেভিয়া বাড়িহয়ে গেছে কিন্তু সেই বাড়ির লোকেরাও আজ জানে না কে বা কারা ছিল এই ভিয়া বা ভূঁইয়া নিজের বাড়িতেই আজ বিস্মৃত কেদার রায়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘বাংলার বারোভুঁইয়ারা ইতিহাসে বঞ্চিত বড় বড় ইতিহাস গ্রন্থগুলিতে শুধু মুঘল-পাঠানদের দ্বন্দ্বই স্থান পেয়েছে, বাংলার এইসব বীর যোদ্ধাদের কাহিনী উপেক্ষিত

ষোল শতকের শেষ দিকে মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মান সিংহ বাংলায় মুঘল শাসন বিস্তারে এসেছিলেন তার প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি কেদার রায়ের হাতে কালিন্দীতে তিনবার পরাজয় বরণ করেন মানসিংহ কেদারের নির্দেশে তারই রাজত্বের শিলাদেবীর মূর্তি জয়পুরের অম্বর প্যালেসে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন শিলাময়ী অদ্যপি তথায় অবস্থান করছেন তার মৃত্যুর পর তার রাজ্য লুণ্ঠন করে মুঘল সৈন্যরা মাটিতে মিশে যায় তার রাজধানী শ্রীপুর

ঈসা খাঁর সাথে বন্ধুত্ব : বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম ঈসা খাঁয়ের সাথে দুই ভাইয়ের সখ্য ছিল| মোগলবিরোধিতা তার একটা কারণ কেদার রায় আর ঈশা খাঁ দুজনে ছিলেন ভাল বন্ধু একসাথে যুদ্ধ করেছেন আরাকান রাজের বিরুদ্ধে জয়ীও হয়েছেন অল্পকাল ছিল বন্ধুত্ব সেই অল্পকালেই এই মিলিত শক্তিকে ভয় পেত আরাকানের মগ বাহিনী মানসিংহও অনেক ছক কষেছিলেন এই মিলিত বাহিনীর জন্য ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথ কর্তৃক সম্রাট আকবরের দরবারে প্রেরিত দূত রালফ ফিচ উল্লেখ করেছেন, তার শ্রীপুর সফরকালে (১৫৮৬) তথাকার শাসক আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন কুতলু লোহানীর (উড়িষ্যার লোহানী রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা) সঙ্গে কেদার রায়ের সখ্যতা ছিল তিনি খাজা সুলায়মান লোহানীর সহযোগিতায় মুঘল দুর্গাধিপতির নিকট থেকে ১৫৯৩ সালে ভূষণা দুর্গ দখল করেন এবং ১৫৯৬ সাল পর্যন্ত দুর্গ স্বীয় অধিকারে রাখেন ওই বছরই দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী ভূষণা দুর্গ আক্রমণ করে মুঘল অবরোধকালে দুর্গের অভ্যন্তরে কামানের গোলা বিস্ফোরণে সুলায়মান লোহানী নিহত হন এবং কেদার রায় আহত হয়ে সোনারগাঁওয়ে ঈসা খাঁর নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন

ঈসা খাঁর সাথে শত্রুতা : পরবর্তী কালে, কেদার চাঁদের সাথে ঈসার বন্ধুত্ব শত্রুতায় পরিণত হয়৷ এর কারণরূপে ঈসা খায়ে, চাঁদের বিধবা কন্যা স্বর্ণমনি বা স্কর্ণময়ীকে ছলপূর্বক বিবাহ করাকে ধরা হয়৷ স্বর্ণময়ীর রূপ দেখে মোহিত হয়ে পড়েন ঈসা খাঁ বিয়ে করতে চাইলেন বিধবা স্বর্ণময়ীকে পিতা চাঁদ রায় আর কেদার রায় দুজনেই ভয়াবহ ক্ষেপে উঠলেন অমন কথা শুনে কেদার রায় আর ঈসা খাঁর বন্ধুত্ব সেখানেই শেষ ঈসা খাঁ কিন্তু প্রস্তাব দিয়েই বসে থাকলেন না একদিন যাত্রা পথে আক্রমন করে স্বর্ণময়ীকে তুলে নিয়ে যায় তার নাম হল সোনাবিবি অনেকে বলে সেই স্বর্ণময়ী বা সোনাবিবির নামেই ঈসা খাঁর রাজধানীর নাম সোনারগাঁ ঈসা এনায়ৎ খানকে দূতরূপে পাঠিয়েছিলেন চাঁদ রায়ের কাছে পত্র প্রেরণ করতে, যাতে ঈসা তার কণ্যার পাণিগ্রহণের প্রস্তাব রেখেছিলেন৷ এর ফলে ক্রুদ্ধ ভ্রাতৃদ্বয় ঈসা খানের কলাগাছিয়া দুর্গ আক্রমণ করে বিধ্বস্ত করেন| সেখান থেকে ঈসা পলায়ণ করে ত্রিবেণী দুর্গে চলে যান| বলা হয় যে এসময়ই কেদার চাঁদের কুলগুরু শ্রীমন্ত খাঁ (ভট্টাচার্য) স্বর্ণমণিকে ছলপূর্বক ইসার হাতে সমর্পন করেন| শ্রীমন্তের প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণ ছিল তার পরিবর্তে এক দেবল ব্রাহ্মণকে কেদার-চাঁদ ভ্রাতৃদ্বয়ের গুরু রূপে গ্রহণ করা৷

তীব্র সংঘাত হেতু কেদার রায় ঈসা খানের একের পর এক অঞ্চল বিধ্বস্ত করায়ত্ত করতে থাকেন৷ চাঁদ রায় শ্রীমন্তের বিশ্বাসঘাতকতা নিজ কন্যার ঈসা কর্তৃক তার রাজধানী তথা সোনারগাঁ এর খিজিরপুরে (বর্তমানে হাজিগঞ্জ) বন্দী হওয়ার ঘটনা শুনে শোকাহত হন এবং কিছুকালের মধ্যেই হৃদরোগে তার দেহাবসান ঘটে৷ কেদার অগ্রজের মৃত্যুর ফলে শোকে কিছুকাল রাজকার্য থেকে বিরত থাকেন৷ মন্ত্রী রঘুনন্দন চৌধুরী এই অল্প সময় দক্ষতার সাথে রাজ্য চালান৷ ঈসা খানকে তার জীবৎকাল পর্যন্ত বারবার কেদারের আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছিল আরাকান রাজের সাথে যুদ্ধে কেউ কাউকে সাহায্য করলেন ন৷

নৌবাহিনী : তিনি বিপুলসংখ্যক রণতরীর অধিকারী কেদার রায় একটি সুশিক্ষিত নৌবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন এবং কিছু ভাগ্যান্বেষী পর্তুগিজকে তার রণতরীর অধ্যক্ষ নিয়োগ করেছিলেন তাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন কার্ভালো

দস্যু দমন মোগলদের সাথে যুদ্ধ : সেই যুগে শুধু পাঠান-মোগল নয়, মগ ফিরিঙ্গিদের অত্যাচারেও বঙ্গবাসী অতীষ্ঠ ছিল| লবণের খনিরূপে বিখ্যাত সন্দ্বীপকে ঘিরে বাঙালি-মগ-পর্তুগীজ-মোগল দের মধ্যে বহু যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল| নাবিক পর্তুগীজদের সকলেই যে দস্যু ছিলেন তা নয় তবে অবশ্যই তাদের মধ্যে অনেক অত্যাচারী হার্মাদ ছিল| ফিরিঙ্গিদের পরাজিত করে কেদার রায় কৌশলে তাদের নিজ রাজত্বের অঙ্গীভূত করেন এবং কার্ভালিয়ান/কার্ভালিয়াস বা কার্ভালোকে করের বিনিময়ে সন্দ্বীপের রাজকার্য সামলে দেন| কার্ভালো কেদার রায়ের নৌবাহিনীর প্রধান হন| এই সময় মোগল সেনারা সন্দ্বীপ ঘিরে ফেললে কার্ভালোর সাহায্যার্থে কেদার সৈন্যপ্রেরণ করেন এবং যুদ্ধে পরাস্ত করে মোগলদের বিতাড়িত করেন৷

অন্যদিকে আরাকানরাজ মেংরাজাগি বা সেলিমশার দৃষ্টি সর্বদাই সন্দ্বীপের উপর ছিল| তিনি ১৫০ রণতরী পাঠিয়ে সন্দ্বীপ হস্তগত করতে চাইলে কেদারের বাহিনীর সাথে তার যুদ্ধ হয় এবং মগরা পরাজিত হয়, সাথে ১৪০ টি তরী কেদার রায় হস্তগত করে ফেলেন| ক্রোধোন্মত্ত আরাকানসম্রাট পরের বার ১০০০ রণতরী বিপুল সৈন্য প্রেরণ করলে আরও ভীষণ যুদ্ধ হয় এবং এতেও মগরা পরাজিত হয়, ফলস্বরূপ প্রায় ২০০০ মগসৈন্য এতে নিহত হয়| অবিভক্ত বঙ্গের ইতিহাস অনুসারে, এমন ভীষণ নৌযুদ্ধ বাংলায় আর দেখা যায়নি| পরবর্তীতে কাভার্লো ক্ষতিগ্রস্ত তরীগুলো মেরামতের জন্য শ্রীপুরে যান| কেদার রায় সময় মোগলদের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যতিব্যস্ত থাকায় আরাকানরাজ সন্দ্বীপ দখল করে ফেল৷

মান সিংহ দ্বিতীয়বার কেদারের সম্মুখীন হতে প্রস্তুত| তিনি মন্দা রায়ের নেতৃত্বে কেদারের বিরুদ্ধে অর্ধচন্দ্রযুক্ত পতাকাসহ মোগল নৌবাহিনী প্রেরণ করলে কালিন্দী নদীতে ভীষণ যুদ্ধ হয়| যুদ্ধে মন্দা রায় কেদার কর্তৃক পরাজিত নিহত হয়| এই যুদ্ধে অধিকাংশ মোগলসেনা নিহত হয় এবং অবশিষ্ট সেনা পলায়ণ করে| তাদের শোণিতধারায় কালিন্দীর জল রক্তিম হয়ে উঠে| কার্ভালো ছাড়া কেদারের যে কজন সেনাপতি অন্যতম যোদ্ধাদের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন রঘুনন্দন রায়, রামরাজা সর্দ্দার, পর্তুগিজ ফ্রান্সিস, কালীদাস ঢালী, শেখ কালু|

পরের বার মান সিংহ সেনাপতি কিলমক খানকে সৈন্যসমেত প্রেরণ করলে সেও পরাজিত বন্দী হয়| ইউরোপীয় ভ্রমণকারীরা তাদের বর্ণনায় কেদার রায় মান সিংহ এর মধ্যে চারবার যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছেন|

 চতুর্থ বার মান সিংহ বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিক্রমপুরের দিকে অগ্রসর হন| সুসঙ্গ রাজবংশের রাজা রঘুনাথ সিংহ মোঘল সম্রাট আকবরের সিংহাসনারোহনের পর তার সাথে এক চুক্তি করেন এই চুক্তির অংশ হিসেবে রাজা রঘুনাথ সিংহকে মানসিংংহ এর পক্ষে বিক্রমপুরের চাঁদ রায়, কোদার রায় এর বিপক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে হয় প্রায় নয় দিন ব্যাপী এই ভীষণ যুদ্ধ চলতে থাকে| পরিশেষে কেদার রায় পরাস্ত হলে রাজা রঘুনাথ সেখান থেকে অষ্ট ধাতুর এক দুর্গা প্রতিমা নিয়ে আসেন এবং রাজ মন্দিরে স্থাপন করেন যা আজো দশভূজা মন্দির নামে সুপরিচিত তখন থেকেই সু-সঙ্গের সাথে দুর্গাপুর যোগ করে অঞ্চলের নামকরণ হয় সুসঙ্গ দুর্গাপুর এবং বলা হয় যে তার কিছুকাল পরে আরও যুদ্ধ চললে বিদ্রোহ দমন করে কেদারের রাজ্য বিদ্রোহীদের তথা রঘুনন্দন, রামরাজা, শেখ কালু, ফ্রান্সিসদের মধ্যে বণ্টন করে মান সিংহ প্রত্যাবর্তন করেন|

মৃত্যু : বঙ্গের এই বীরের ট্রাজেডি সম্বন্ধে পরস্পরবিরোধী কিছু প্রবাদ তথ্য মেলে|

প্রথমত, বলা হয় যে নবম দিন বীরবিক্রমে লড়াই করার সময় সহসা এক কামানের গোলার আঘাতে কেদার রায় মূর্ছিত হন এবং বন্দী হওয়ার কিছু কাল পরে তার মৃত্যু হয়৷  

দ্বিতীয়ত, নবম (অথবা দশম) দিন যুদ্ধ শুরুর আগে প্রথামত কেদার রায় ইষ্টদেবী ছিন্নমস্তার পূজা করতে গেলে ধ্যানস্থ অবস্থায় তাকে গুপ্তঘাতক দ্বারা মুন্ডচ্ছেদ করেন মান সিংহ৷  

তৃতীয়ত, কেদার পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও মানসিং কেদারের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে রাজ্যে তার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন| মান সিংহর এহেন কিছু কর্মের উদাহরণ ইতিহাসে যে বিরল তা নয৷  

তবে অনেকেই কেদার রায় সম্বন্ধে প্রাপ্ত তথ্যগুলির উপর ভিত্তি করে সেগুলির সম্ভাব্য উপসংহাররূপে প্রথম দুটিকে অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে করে৷ 

মোগলদের বিরুদ্ধে বারো ভুঁইয়াদের একজোট করতে কেদার রায় বহু চেষ্টা করেন, কিয়ত্সাফল্য লাভ করলেও তিনি কার্যে বিফল হন শেষ পর্যন্ত| তারা একজোট হলে হয়তো পরবর্তী ইতিহাস অন্যরকম হতো কিন্তু বারোভুঁইয়াদের মধ্যে রেষারেষি চরম স্তরের ছিল, এর সুবিধা মানসিংহ অবশ্যই পেয়েছিলেন| তবে কেদার রায়ের কৃতিত্ব দেশপ্রেমীদের কাছে অবশ্যই অক্ষয় অমর হয়ে থাকবে| বহু টোল, পাঠশালা, মন্দির, কারাগার ,কোষাগার, সেনা ছাউনী তিনি নির্মাণ করেছিলেন| তার প্রজাবাৎসল্য বহুচর্চিত বন্দিত ছিল| যদিও তার বহু কীর্তি পদ্মানদীর জলে ভেস্তে গিয়েছে| এর ফলে পদ্মা শ্রীপুর স্থানেকীর্তিনাশাবলে পরিচিত|

পরিশেষে মানসিং কেদার রায়ের মধ্যে এক বিখ্যাত পত্রবিনিময়ের কথা না উল্লেখ করলেই নয়|মানসিং দূত দ্বারা কেদারের নিকট তরবারি শৃঙ্খল প্রেরণ করেন এবং মিশ্র ভাষায় এক পত্র লেখেন,

ত্রিপুর মগ বাঙ্গালী, কাক কুলি চাকালি

সকল পুরুষমেতৎ ভাগি যাও পলায়ী

হয়-গজ-নর-নৌকা কম্পিতা বঙ্গভূমি

বিষম সমর সিংহো মানসিংহশ্চয়াতি|”

শেষ লাইনটার অর্থ হল সমরক্ষেত্রে যার সিংহের ন্যায় বিচরণ সেই মানসিংহ আসছেন |

প্রত্যুত্তরে কেদার লিখে পাঠান

ভিনতি নিত্যং করিরাজ কুম্ভং

বিভর্তি বেগং পবনাতিরেকং

করোতি বাসং গিরিরাজ শৃঙ্গে

তথাপি সিংহঃ পশুরেব নান্যঃ||”

অর্থাত বায়ুর অপেক্ষা (অধিক) বেগ সিংহের, নিয়ত হস্তীমুন্ড বিদারণ করে, পর্বতের উচ্চশৃঙ্গে অবস্থানও করে, তবুও সিংহ পরিশেষে একটি পশুই| তিনি আরও বলেন "ভেবে দেখো শৃঙ্খল কার পায়ে সাজে তরবারি লইলাম লাগাইব কাজে|" বলাই বাহুল্য যে তার চারিত্রিক তেজ বীরবিক্রম এই প্রত্যুত্তরের অক্ষরে অক্ষরে প্রকাশ পায়|

কেদার রায়ের স্মৃতিবিজড়িত স্থান : বাংলাদেশের টংগিবাড়ীতে প্রাচীন মন্দির-জনশ্রুতি রাজা কেদার রায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত

  • ফতেজঙ্গপুর দুর্গনড়িয়া উপজেলা, শরিয়তপুর, বাংলাদেশ কথিত আছে এই স্থানে মান সিংহ নেতৃত্বাধীন মোঘল বাহিনী রাজা কেদার রায়ের প্রতিরোধকারী বাহিনীর মধ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় প্রাচীন নাম শ্রীনগর মুঘল সেনাপতি রাজমানসিংহ যখন বিক্রমপুর আক্রমণ করেন তখন তার সহযোগী যোদ্ধাগণ এখানকার রাজা কেদার রায় কর্তৃক পরাস্ত হয়ে শ্রীনগরে আশ্রয় নিয়েছিলেন মানসিংহ তাদেরকেউদ্ধারের জন্য তার সেনাবাহিণী প্রেরণ করেন ফলে প্রচন্ড যুদ্ধ সংঘঠিত হয় তিনি মোগলদের জয়ের চিহ্ন স্বরুপ মানসিংহ শ্রীনগরের নাম পরিবর্তন করে ফতেজঙ্গপুর রাখেন এখানে নাককাটা বাসুদেবের প্রস্থর মূর্তি আছে

  • কেদারপুর - নড়িয়া উপজেলা, শরিয়তপুর, বাংলাদেশ কেদার রায় এখানে বাসস্থান তৈরী করতে চেয়েছিলেন কিছু কাজ সমাপানান্তে তারমৃত্যু হওয়াতে উহ পরিত্যক্ত হয় বাড়ির চতুষ্পার্শ্বে যে পরিখা খনন করতেছিলেন তার ভগ্নাবশেষ এখনও বিদ্যমান ইহাকে কেদার রায়ের বাড়ির বেড় (পরিখা) বলে

  • আরা ফুলবাড়িয়ায় কেদার রায়ের পরিবারের আদি বাসস্থল এখনো চিহ্নিত করা যায় এখানে একটি উঁচু বিস্তৃত ভিটা এখনোকেদার বাড়িনামে পরিচিত আরা ফুলবাড়িয়ায় কেদার রায়ের খননকৃত একটি দিঘি এখনো বর্তমান কেদার রায়ের অগ্রজ চাঁদ রায়ের সময়ে খনন করা অপর একটি দিঘিও টিকে আছে চাঁদ রায়ের এক দাসীর নামে দিঘিটির নামকরণ হয়কেশব মা কা দিঘি শ্রীপুর জমিদারদের নির্মিত সর্বাধিক সুবিদিত স্থাপত্য নিদর্শন সুউচ্চ রাজবাড়ির মঠ একসময় পদ্মার তীরে যেখান থেকে শ্রীপুর শহর শুরু হয় তার অনতিদূরেই নির্মিত হয়েছিল মঠটি এই সুউচ্চ মঠটি কয়েক মাইল দূর থেকেও দেখা যেতকেদার রায় অনেক মন্দির প্ৰতিষ্ঠা দীঘি খনন করেন

  • কেদার রায়ের প্রতিষ্ঠিত ভুবনেশ্বরী মূর্তি নদীয়া জেলায় কালীগঞ্জ থানার অধীন লাখুরিয়া গ্রামের চৌধুরী মহাশয়দিগের বাটীতে অস্থাপি বিরাজিত আছেন তাহার পদোপরি কেদার রায়ের নাম খোদিত আছে

কেদারপুর নামক গ্রামেও তাদের অনেক কীৰ্ত্তির নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় সৰ্ব্বপেক্ষ পদ্মার তীরস্থ রাজবাড়ী মঠ তাদের বিরাট কীৰ্ত্তির পরিচয় দিয়েছে এই চতুশ্চূড়া শিবমন্দির নানা প্রকার খোদিতচিত্ৰ ইষ্টকে ভূষিত হয়ে বাঙ্গলায় প্রাচীন স্থাপত্যেরও সাক্ষ্য দিতেছে
আর্টিকেল'টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিবেন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।
গৌরব রায়
বাংলা বিভাগ, 
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ। 
লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে : ক্লিক করুন
আরো পড়ুন:
রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ২ ক্লিক করুন
রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৩ ক্লিক করুন
রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৪ ক্লিক করুন
রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৫ ক্লিক করুন
রায় পদবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম, পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য কর্ম: পার্ট- ৬ ক্লিক করুন
তথ্যসূত্র:
আর্টিকেলের সকল তথ্য উইকিপিডিয়া ও গুগল থেকে নেওয়া!

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.